জীবনের সেই পরম লগ্নে প্রথম প্রেমের উন্মাদনায় দুজনেই একটু বেহিসেবী হয়ে পড়েছিল। সমস্ত রাত্রির অন্ধকারের পর যখন প্রথম সূর্য ওঠে তখন সমস্ত দিগন্ত রাঙিয়ে সে আত্মপ্রকাশ করে। সারা রাত্রির মৌনের পর যখন পাখির ঘুম ভাঙে, যখন দিনের আলোর প্রথম ইঙ্গিত পায়, অনাগত সূর্যকিরণের প্রথম স্পর্শের সামান্যতম অনুভূতি উপলব্ধি করে, তখন তার কলকাকলী সারা বিশ্বকে জাগিয়ে দেয়। একটু বেলা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের রক্তিম আভা বিদায় নেয়, পাখিদেব কলকাকলীও থেমে যায়। পরিচয়ের পর্ব শেষ হবার পর যখন দুজন দুজনকে সম্যকভাবে আবিষ্কার করল, উপলব্ধি করল, তখন সে উন্মাদনা, সে আধিক্য বিদায় নিল।
খসরুবাগের পিছন দিকের বাগানে কবিতার প্রথম পোর্ট্রেট আঁকল অলক। কবিতা স্থির হয়ে বসতে পারে না বেশিক্ষণ। দশপনেরো মিনিট পরপরই ছটফট করে উঠত। অলক তাকে ধরে নিয়ে বসিয়ে দিত। মুখটা নড়ে গেলে একটু ঘুরিয়ে ফিবিয়ে ঠিক করে দিত, লম্বা বিনুনীটা আবার পেছন থেকে টেনে এনে সামনে বুকের ওপর ঝুলিয়ে দিত ঠিক আগের মতো করে। আবার দশপনেরো মিনিটের মধ্যে সব কিছু ঠিক রেখেও এ্যাঙ্গেলটা করে দিত কবিতা। কখনও কখনও একটু বাকে, একটু আদর করে আবার ঠিক করে নিত অলক।
পোর্ট্রেটটা যখন শেষ হল তখন চমকে উঠেছিল কবিতা। দুহাতে তালি বাজিয়ে বলেছিল, আঃ ওয়ান্ডারফুল!
ভাবের বন্যায়, তৃপ্তির আনন্দে, ভালোবাসার আতিশয্যে কবিতা দুহাত দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিল অলককে। আর অলক? গঙ্গার মতো স্নিগ্ধ শান্ত অলক হঠাৎ পদ্মার মতো পাগল হয়ে উঠেছিল কবিতার প্রথম আলিঙ্গনে, কেউটে সাপের বিষের মতো ভালোবাসার বিষ ঢেলেছিল কবিতার দুটি ওষ্ঠে।
মিনিট দুই পরে দুজনেরই সম্বিত ফিরে এসেছিল। দুজনেই লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। লজ্জায় কারুর মুখ দিয়েই কথা বেরোয়নি বেশ কিছুক্ষণ। প্রথম নিস্তব্ধতা ভাঙল অলক, কবিতা।
উঃ
রাগ করলে?
কোন উত্তর দেয় না কবিতা। শুধু মুচকি হাসে।
অলক আবার প্রশ্ন করে, বল না কবিতা, রাগ করছ?
কবিতা আলতো করে অলকের কাঁধে মাথা রেখে ক্ষীণকণ্ঠে বলে, উঁহু!
.
এরপর অলক-কবিতার জীবন থেকে যেন শীতের জড়তা কেটে গেল, যেন কোনো ইঙ্গিত না দিয়ে কালবৈশাখীর ঝড় উঠল দুটি প্রাণের গহন রাজ্যে! প্রায় ঝড়ের বেগে দুরন্ত বার পদ্মার মতো দুটি জীবন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চললল।
এলাহাবাদের পরিচিত মানুষের ভিড়ের মধ্যে সীমিত স্বাধীনতায় মন ভরে না। দুটি প্রাণ, দুটি মন, দুটি আত্মা অন্তহীন আকাশের তলায় দিগন্ত বিস্তৃত উন্মুক্ত প্রান্তরের স্বাধীন পরিবেশে মিলতে চায়, চায় ভালোবাসার প্রয়াগতীর্থে বিলীন হয়ে যেতে।
.
অলক বলে, জানো ডাক্তার, কামনাবৃত্তির মধ্যে ভালোবাসা না থাকতে পারে, কিন্তু ভালোবাসার মধ্যে নিশ্চয়ই কামনাবৃত্তি লুকিয়ে থাকে। রক্তমাংসের মানুষ এর উর্ধ্বে যেতে পারে না, আমরাও পারিনি। দুজনেই সে আগুনের উত্তাপ উপলব্ধি করেছিলাম, কিন্তু ভবিষ্যতের চিন্তা করে সে আগুনে আহুতি দিতে পারিনি!
দুজনেই ঠিক করলাম, আর কিছু না হোক অন্তত লোকারণ্যের বাইরে সমাজের শ্যেন চক্ষুর আড়ালে দুজনে নিঃসঙ্গ তীর্থ যাত্রা করব, আগামী দিনের ইতিহাসের বুনিয়াদ তৈরি করব। কবিতা তার অন্তরঙ্গ বন্ধু পূর্ণিমার সঙ্গে পূর্ণিমার দিল্লিবাসী মামার কাছে যাবার অনুমতি নিল বাবা-মার কাছ থেকে। আমিও গেলাম। উদয় অস্ত ঘুরে বেড়িয়েছি দুজনে। হেসেছি, খেলেছি, আনন্দ করেছি, করেছি ভবিষ্যতের পরিকল্পনাকে পাকাপাকি।
পূর্ণিমার মামা গাড়িতে করে আগ্রা-জয়পুর দেখার প্রোগ্রাম করলেন। হঠাৎ যাবার আগের দিন সন্ধ্যায় কবিতা জানাল, তার শরীর খারাপ। মামা প্রোগ্রাম বাতিল করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কবিতা বলেছে, তা হয় না মামা। মামা বার বার আপত্তি করেছেন, কবিতাও বার বারই আপত্তি করেছে। শেষে মামা মামীকে রেখে যেতে চেয়েছেন, কিন্তু তখন পূর্ণিমা বলেছে, না মামা, তা হয় না। মামী না গেলে আমিও যাব না। মামা ঠিক রাজি হতে পারেননি, কিন্তু পূর্ণিমা বলেছে, দুটো দিন আমাদের ছাড়া থাকলে কবিতা উড়ে যাবে না। বেশ থাকতে পারবে। তাছাড়া বুড়ো রামনাথ তো রইল।
মামা-মামী পূর্ণিমা রওনা হবার পরই কবিতার শরীর ঠিক হয়ে গেল। কবিতাকে নিয়ে সেদিন আমি গেলাম রিজ-এ! অনেক গল্প, অনেক গান হল, ভবিষ্যৎ নিয়েও অনেক আলোচনা হল। স্থির হল, এবার এলাহাবাদ ফিরে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই দুটি জীবন একই গ্রন্থিতে বাঁধবার ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর দুজনে চলে যাব বোম্বে, খুলব স্টুডিও।
কিছুদিন পরে কবিতাকে একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড় করালাম। আর আমি রঙ তুলি দিয়ে প্রাণহীন ক্যানভাসে আমার মনের প্রতিমাকে গড়ে তুলতে শুরু করলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মোটামুটি স্কেচটা করে নিলাম। কবিতা আর স্থির থাকতে পারল না। আমার সঙ্গে ঠাট্টা করতে করতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। আমি অনেকবার বারণ করলাম, কবিতা, এতো হুড়োহুড়ি করো না। হঠাৎ কোনো পাথরে চোট লেগে যাবে। আমি যত বারণ করি, আমাকে রাগাবার জন্য ও তত বেশি দৌড়াদৌড়ি করে। শেষে হঠাৎ একবার একটা গোল পাথরের ওপর পা পড়া মাত্র কবিতা ছিটকে গড়িয়ে পড়ল অনেক দূরে। মনে পড়ে ওর শুধু একটা বিকট চিৎকার শুনেছিলাম। আমি দৌড়ে লাফিয়ে গেলাম ওর পাশে। দেখি আধাশুকনো মোটা ডালে খোঁচা খেয়ে হাত পা রক্তারক্তি হয়েছে। চীৎকার করে ডাক দিলাম, কবিতা?