জানি।
তাহলে?
তাহলে কী?
যদি আপনার মামা থানায় রিপোর্ট করেন, তাহলে তো পুলিশ আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে।
অলকানন্দা অত্যন্ত দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে, সুদীপ্তবাবু, আমি কচি বাচ্চা না। চব্বিশ বছরের একজন যুবতী। তাছাড়া আমি সুস্থ স্বাভাবিক। আমি আমার ইচ্ছা ঘোরাঘুবি, কাজকর্ম বিয়েথা সবকিছুই করতে পারি। মামামামী তো দূরের কথা, পুলিশে সে ব্যাপারে কিছু করার অধিকার নেই।
সুদীপ্ত একটু হেসে বলে, তা ঠিক কিন্তু তবুও বলছি, পুলিশ আপনাকে ধরে আপনার মামামামী বা মার কাছে পৌঁছে দিতে পারে।
অলকানন্দাও হেসে বলে, সামান্য পুলিশের কথা তো বাদই দিচ্ছি; নাগরিক হিসাবে আমার মৌলিক অধিকারে নাক গলাবার অধিকার প্রাইম মিনিস্টারেরও নেই।
যদি আজ রাত্তিরেই পুলিশ আপনাকে ধরতে আসে?
যে পুলিশ অফিসার ধরতে আসবেন, তার কপালে অশেষ দুঃখ আছে।
ওর কথা শুনে সুদীপ্ত হো হো করে হাসে। তারপর বলে, আপনি তো দারুণ মেয়ে!
হ্যা সুদীপ্তবাবু, সত্যি আমি দারুণ মেয়ে। আমি মানুষকে ভালোবাসতে জানি কিন্তু ভয় করতে শিখিনি।
দুএক মিনিট দুজনেই চুপচাপ। তারপর অলকানন্দই আবার কথা বলে, আমার কথা তো অনেক শুনলেন। এবার আপনার কথা বলুন।
আমার কথা আর কী শুনবেন? আমি অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন।
চোদ্দ আনা বাঙালিই তো মধ্যবিত্ত; সেজন্য দুঃখ বা আক্ষেপ করার কি আছে?
না, না, দুঃখ করছি না; আমি এতই সাধারণ যে বলার কিছু নেই।
আপনি সাধারণ কি অসাধারণ, সে বিচার তো অন্যেরা করবেন।
তা ঠিক।
বলুন। লেখাপড়া কোথায় করেছেন?
লেখাপড়ায় তো আপনার মতো ভালো ছিলাম না, তাই কি শুনবেন?
আঃ, আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই। বলুন, কোন কলেজে পড়েছেন?
সেন্ট জেভিয়ার্সে।
কীসে অনার্স ছিল?
আমি অনার্স নিয়ে পড়েছি, তা কী করে ভাবলেন?
আবার তর্ক করছেন? বলুন, কীসে অনার্স ছিল।
ইংরেজিতে।
এম. এ. পড়লেন কোথায়? কলকাতায় না যাদবপুরে?
কলকাতায়।
কবে পাশ করেছেন?
সেকি আজকের কথা? আমি যখন পাশ করি, তখন স্যার আশুতোষ ভাইস চ্যান্সেলার।
অলকানন্দা চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলে, আপনি যে আশুতোষের আমলের মানুষ তা তো আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি। কোন কলেজে পড়াচ্ছেন, তাই বলুন।
এত ভালো রেজাল্ট করেছিলাম যে কলেজে পড়াবার স্বপ্ন দেখারও সাহস হয়নি।
তাহলে কী করছেন?
সে কথা জিজ্ঞেস করে আর লজ্জা দেবেন না।
কেন? আপনি কি চুরি করছেন যে বলতে লজ্জা হচ্ছে?
না, চুরি করছি না ঠিকই কিন্তু যা করছি, সেটাও খুব গৌরবের নয়।
অলকানন্দা সঙ্গে সঙ্গে বলে, আপনার বড্ড ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স! আপনি যদি এম. এ. পাশ করে দারোয়ানের চাকরিও করেন, তাহলে তো দেশের নেতাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। আপনি লজ্জা পাবেন কেন?
সুদীপ্ত ঐ প্রসঙ্গে কোনো জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, শুতে যান, অনেক রাত হয়েছে।
অলকানন্দাও উঠে দাঁড়িয়ে বলে শুতে যাচ্ছি কিন্তু কাল সকালে আবার ঝগড়া করতে হবে। এখানে কদিন থাকরেন?
আপনি যে কদিন থাকরেন, আমিও সেই কদিন থাকব।
আমি যদি কালই এখান থেকে চলে যাই?
আপনার আপত্তি না থাকলে আমিও আপনার সঙ্গে অন্য কোথাও যেতে পারি।
কলকাতা ফেরার তাড়া নেই?
তাড়াতাড়ি ফিরলেই ভালো হয়; তবে একটু দেরি হলেও অসুবিধে নেই।
আচ্ছা গুড নাইট! কাল সকালে আবার কথা হবে।
গুড নাইট!
.
পরের দিন সকালে সুদীপ্ত ব্রেকফাস্টের জন্য ডাইনিং হলএ ঢুকতেই কোণার দিকে একটা টেবিল থেকে অলকানন্দা ইশারায় ডাকল
সুদীপ্ত সামনের চেয়ারে বসতেই অলকানন্দা বলল, কাল রাত্তিরে বোধহয় আমার কথাবার্তায় আপনি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন, তাই না?
সুদীপ্ত একটু হেসে বলে, না, না, অসন্তুষ্ট হবে কেন? বরং আপনার স্পষ্ট কথাবার্তা খুব ভালো লেগেছে।
অলকানন্দাও একটু হেসে বলে, আমি একটু স্পষ্ট কথাবার্তা বললেও মেয়েটা খুব খারাপ না।
সুদীপ্ত চাপা হাসি হেসে বলে, আমাকে পেটের দায়ে অনেক বিচিত্র ধরনের মানুষ ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়। আপনি যে খারাপ না, তা আমি অনেক আগেই বুঝেছি!
বেয়ারা খাবারের অর্ডার নিয়ে চলে যেতেই অলকানন্দা জিজ্ঞেস করে, আপনি কোথায় চাকরি করেন?
মুহূর্তের মধ্যে একটু চিন্তাভাবনা করেই ও জবাব দেয়, পুলিশ।
পুলিশে?
হ্যাঁ।
পুলিশেই যদি চাকরি করবেন, তাহলে এম. এ. পড়লেন কেন?
এম. এ. পরীক্ষা শুরু হবার ঠিক তিন দিন আগে মা মারা গেলেন। তাই রেজাল্ট বিশেষ ভালো হল না। তাছাড়া একটা চাকরি পাওয়া খুবই জরুরী ছিল।
বেয়ারা খাবার দিয়ে যায় কিন্তু খাওয়া শুরু না করেই অলকানন্দা জিজ্ঞেস করে, আপনার মার কী হয়েছিল?
ক্যান্সার। সুদীপ্ত একটু থেমে বলে, বাবা রিটায়ার করার ঠিক দুবছর আগে মার ক্যান্সার ধরা পড়ে। নবছর রোগ যন্ত্রণা ভোগ করে মা মারা গেলেন কিন্তু মার চিকিৎসার জন্য বাবা দেনার দায়ে ভিখারী হয়ে গেলেন। তাই…।
ইস্! কী দুঃখের কথা!
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। তারপর আস্তে আস্তে খেতে শুরু করে।
খেতে খেতে অলকানন্দা জিজ্ঞাসা করে, আপনার বাবা কী করতেন?
স্কুলে মাস্টারি করতেন।
স্কুল থেকে রিটায়ার করার পর কোনো কোচিংটোচিং..
সুদীপ্ত একটু ম্লান হাসি হেসে বলে, মা মারা যাবার দেড় বছরের মধ্যেই বাবা চলে যান।
মাই গড!
আবার কিছুক্ষণ নীরবতার পর অলকানন্দা জিজ্ঞেস কবে, আপনারা কভাই বোন?
সুদীপ্ত একটু হেসে বলে, আমার ঠাকুর্দা বাবামায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। বাবারও কোনো ভাইবোন ছিল না। তবে আমার এক দিদি আছে কিন্তু বিশেষ যোগাযোগ নেই।