সূর্যদেব ঢলে পড়তে না পড়তেই গাড়িগুলো এই বালির সাম্রাজ্য থেকে পালাবার জন্য শহরের দিকে রওনা হয়। অন্ধকার নামলে এই মরুভূমির দেশে পথভ্রষ্ট দিগভ্রষ্ট হয়ে নিরুদ্দেশ হবার সম্ভাবনা ষোল আনা। টুরিস্ট লজএ ফিরতে আটটা বেজে গেল
কটেজে ঢুকেই সুদীপ্ত ক্লান্তিতে নেয়ারের খাঁটিয়ায় শুয়ে পড়ে। একটু পরে একটা সিগারেট ধরায়। চোখের সামনে শুধু অলকানন্দার বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দর উজ্জ্বল মুখখানাই দেখতে পায়। নানা কথা ভাবে। আপনমনে একটু হাসে। সিগারেট টানতেও যেন ভুলে যায়। একটু পরে এ্যাসট্রেতে সিগারেটটা ফেলে দেয়।
এইভাবে আরো কিছুক্ষণ কেটে যায়। তারপর হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়েই লাফ দিয়ে ওঠে। বাথরুমে যায়। স্নান করে। প্রায় দৌড়ে ডাইনিং হলএ খেতে যায়। দুচারজনকে এদিক ওদিক ছড়িয়েছিটিয়ে বসে থাকতে দেখলেও অলকানন্দাকে দেখতে পায় না।
.
খাওয়াদাওয়ার পর সামনের লনএ অনেককে গল্পগুজব করতে দেখে সুদীপ্ত একটু এদিকওদিক পায়চারি করে, কিন্তু না, সেখানেও অলকানন্দাকে দেখতে পায় না। সুদীপ্ত নিজের কটেজের দিকে এগিয়ে যায়।
একি! একলা একলা এখানে বসে আছেন? আবছা আলোয় কটেজের বাইরে অলকানন্দাকে দেখেই সুদীপ্ত প্রশ্ন করে।
খেয়েদেখে উঠেই তো শোবার অভ্যেস নেই, তাই…
কিন্তু একলা কেন? আপনার বাড়ির অন্যান্যবা…
সুদীপ্তকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই অলকানন্দা বলে, আমি একলাই এসেছি।
একলা?
অলকানন্দা একটু হেসে বলে, কেন, একলা বেড়াতে বেরুনো কী অন্যায়?
না, না, অন্যায় কেন হবে!
সাধারণত আপনার বয়সী মেয়েদের তো বাবা-মায়েরা একলা একলা বেরুতে দেন না। তাছাড়া..
তাছাড়া মেয়েদেরও তো একলা একলা বিশেষ বেরুতে দেখেন না, তাই তো?
হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন।
অলকানন্দা একটি হেসে বলে, আপনিও তো একলা বেরিয়েছেন, তাই না?
হ্যাঁ, আমিও একলাই এসেছি।
এবার অলকানন্দা বলে, যদি এখুনি ঘুমুতে না যান তাহলে আপনার কটেজ থেকে একটা চেয়ার এনে বসুন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আনছি।
সুদীপ্ত নিজের কটেজ থেকে চেয়ার এনে বসতেই অলকানন্দা জিজ্ঞেস করে, আপনি চলকাতায় থাকেন?
হা; আপনি?
হ্যাঁ, আমিও কলকাতার বাসিন্দা।
আপনি নিশ্চয়ই বাবা-মায়ের খুব আদুরে?
অলকানন্দা একটু হেসে জিজ্ঞেস করে, কেন বলুন তো?
এই আপনি একলা একলা বেরিয়েছেন, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
আমার বাবা নেই।
নেই?
না। মুহূর্তের জন্য একটু থেমে ও বলে, তবে বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন।
আমাকে অসম্ভব ভালোবাসেন।
সুদীপ্ত সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রশ্ন করতে পারে না। একটু পরে প্রশ্ন করে, আপনি নিশ্চয়ই পড়াশুনা করছেন?
আবছা আলোতেও সুদীপ্ত দেখে, অলকানন্দা একটু ভাবে, একটু হাসে। তারপর বলে, পড়াশুনা করছি, তাও বলা যায়, আবার করছি না, তাও বলতে পারি।
তার মানে?
অলকানন্দা একটু স্পষ্ট করেই হেসে বলে, কোনোমতে এম. এ. ডিগ্রী জোগাড় করে। ফেলোশিপও পেয়েছি কিন্তু পড়াশুনা বিশেষ কিছু করছি না।
ফেলোশিপ মানে ইউজিসির ফেলোশিপ?
হ্যাঁ।
সুদীপ্ত হাসতে হাসতেই বলে, আপনি তো দারুণ খারাপ ছাত্রী!
ওর কথা শুনে অলকানন্দা না হেসে পারে না। তারপর হাসতে হাসতেই বলে, এমন দেখাচ্ছেন যেন আপনি হায়ারসেকেন্ডারিও পাশ করেননি।
প্রায় সেইরকম। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করে, মাকে সঙ্গে আনলেন না কেন?
ওর মুখ থেকে কথাটা বের হতে না হতেই অলকানন্দা বলে, আমি যেভাবে এসেছি সেভাবে তো মাকে আনা যায় না।
আপনি কি উইদাউট রিজার্ভেশনেই ট্রেনে চড়ে পড়েছেন যে মাকে..
না, তা না।
আপনার মা কি ছোট ঘোট ভাইবোনদের দেখাশুনার জন্যই…
আমার আর কোনো ভাইবোন নেই।
তাহলে মাকে একলা রেখে এলেন কেন? তিনিও তো একটু ঘুরেফিরে গেলে…
মাকে একলা রেখে আসিনি; মা আমার এক মামার কাছে আছেন।
তাহলে ভালোই করেছেন। সুদীপ্ত মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, ভাইএর কাছে কদিন তারও নিশ্চয়ই ভালো লাগছে।
না, না, মা বেড়াতে যাননি। বাবা মারা যাবার পর থেকেই আমি আর মা ঐ মামার থাকি
ও!
আপনার ঘুম পাচ্ছে না?
কেন? আপনার ঘুম পাচ্ছে?
এত তাড়াতাড়ি আমার ঘুম আসে না। আমি আর মা রোজ একটাদেড়টা পর্যন্ত গল্প করি।
আচ্ছা।
অলকানন্দা একটু হেসে বলে, রাত্তিরের ঐ গল্পগুজবটুকু না করে আমরা ঘুমুতেই পারি না। আমার নট ওনলি বেস্ট ফ্রেন্ড, শী ইজ অলসো মাই ওনলি ফ্রেন্ড।
ওর কথাটা শুনে সুদীপ্ত খুশির হাসি হেসে বলে, ইউ আর নট ওনলি এ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট বাট অলসো এ ভেরি গুড ডটার?
কিন্তু মা আমার চাইতেও হাজার গুণ ভালো।
আপনার মা নিশ্চয়ই খুব ভালো কিন্তু আপনার মতো মেয়েও তো আজকাল দুর্লভ!
অলকানন্দা সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে বলে, যে মেয়ে বাড়িতে কাউকে কিছু না চলে আসে, সেরকম মেয়ে নিশ্চয়ই দুর্লভ!
চোখ দুটো বড় বড় করে সুদীপ্ত বলে, কী আশ্চর্য! আপনি কাউকে না বলেই এসেছেন? আপনার মা কি রকম চিন্তা করছেন, ভাবুন তো!
বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে ও বলে, মা যাতে চিন্তা না করে, সে ব্যবস্থা করে এসেছি। তবে মামা-মামীকে কিছু জানাইনি।
কিন্তু…
সুদীপ্ত কথাটা শেষ করে না।
কিন্তু কী?
যদি মামামামী থানাপুলিশ করেন?
আমি কী চুরিডাকাতিখুন করে পালিয়েছি যে মামামামী থানাপুলিশ করবে? অলকানন্দা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়।
সুদীপ্ত বলে, না, তা না, কিন্তু বাড়ি থেকে ছেলেমেয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে তো লোকজন থানাপুলিশ করেন।