কি ব্যাপার? তুমি?
রত্না আমার সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, জ্বর হয়েছে একটা খবর তো দিতে পারতে।
একটু মুচকি হেসে রত্নর প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলাম। বললাম, তারিককে একটু ডাক দাও না, কফি খেতাম।
তারিককে একটু আমাদের বোটে পাঠিয়েছি, এখুনি আসছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রত্নার বাবামা এসে হাজির। মহা ব্যস্ত হয়ে চ্যাটার্জী সাহেব আমার নাড়ী পরীক্ষা করলেন, জিভ দেখলেন, কপালে বুকে হাত দিলেন। তারপর তার ছোট্ট অ্যাটাচি থেকে কি যেন একটা হোমিওপ্যাথিক ঔষধ বের করে আমাকে খাইয়ে দিলেন।
পরের দুটি দিন মিস্টার ও মিসেস চ্যাটার্জী এসেছিলেন আমাকে দেখতে। রত্নাও এসেছিল, তবে হিসেব করে নয়। সকালে এসেছে, দুপুরে এসেছে, এসেছে সন্ধ্যায় ও রাত্তিরে। আমার তদারক করেছে, আমার সঙ্গে গল্প করেছে। দুটি দিন পরেই আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলাম, কিন্তু তবুও রত্না আসত, আসত গল্প করতে, গল্প শুনতে।
কয়েকদিন পর লক্ষ্য করলাম, রত্না কি যেন আমাকে বলতে চায় অথচ বলে না বা বলতে পারে না। একটি একটি করে দিন চলে যায়, আমার শ্রীনগর ত্যাগের আগের দিন সন্ধ্যায় মিস্টার ও মিসেস চ্যাটার্জী রত্নাকে নিয়ে এলেন আমার হাউস বোটে। অনেক গল্পগুজব হল। শেষে ওঁরা বিদায় নিলেন।
রত্না বলল, মা তোমরা যাও, আমি একটু পরে যাচ্ছি।
রত্না আর দেরি করেনি। সেদিন রাত্রে আমার হাউস বোটের ছাদে বসে আবছা চাঁদের আলোয় তার জীবন নাট্যের নাতিদীর্ঘ অথচ ঘটনাবহুল কাহিনি শুনিয়েছিল আমাকে। নির্বাক, নিশ্চল, মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে কাহিনি শুনেছিলাম আমি।
০২.
প্রথম মাস দুই সারা লন্ডন শহরটাকে চষে ফেলল কিন্তু তবুও কোনো সুরাহা করতে পারল না অলক। পরে একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবে পরিচয় হয় এক ইংরেজ সাংবাদিকের সঙ্গে এবং শেষে তারই সাহায্যে ফ্লীট স্ট্রিটের এক আধাখ্যাত সাপ্তাহিকের আর্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরি পায়। অলকের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে আর্ট ডিরেক্টরের সুপারিশে ছমাসের মধ্যে অলকের মাইনে বারো থেকে পনেরো পাউন্ড হল।
মাইনে বাড়ার পর অলক বাসা পাল্টাল। গোল্ডর্স গ্রীনে একটা ছোট্ট দুখানা ঘরের ফ্ল্যাট নিল। একখানা ঘরে স্টুডিও হল। বেডরুমের কোনো এক কোনায় রান্নার ব্যবস্থা ছিল কিন্তু নিজের বাড়িতে একটু আধটু চা-কফি ছাড়া আর কিছু অলক করতে পারত না। নতুন নতুন যারা দেশ থেকে যায় তারা অবশ্য এর চাইতে বেশি কিছু পারে না। দুচার মাসের মধ্যে সবাইকে রান্নাবান্না শিখে নিতে হয়। অলক সে তাগিদটুকুও বোধ করত না। সকাল বেলায় দুএক কাপ চা খেয়ে অফিস বেরুবার পথে গোল্ডর্স গ্রীন স্টেশনের পাশে একটা ইটালীয়ান রেস্তোরায় হেভী ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিত। দুপুরে লাঞ্চের টাইমে ফ্লীট স্ট্রিটের কোনো না কোনো রেস্টুরেন্টে দুএকটা স্যান্ডউইচ আর এক কাপ কফি খেত।
বিকেলে অফিস ছুটির পর প্রায়ই চারিং ক্রশ অবধি হেঁটে আসত। কোনদিন স্ট্রান্ড, কোনোদিন ভিক্টোরিয়া এম্বব্যাঙ্কমেন্ট ধরে হেঁটে আসতে আসতে অলকের বেশ লাগত মানুষের ভীড় দেখতে। স্ট্র্যান্ডের উইন্ডো শপিংও মন্দ লাগত না। কিছুকাল পরে যখন এসব পুরনো হয়ে গেল তখন সোজা চলে আসত নিজেব ফ্ল্যাটে। নিজের স্টুডিওতে কাজ করত অনেক রাত অবধি।
ল্যান্ড স্কেপের চাইতে জীবন্ত মানুষের পোট্রট আঁকতেই অলকের বেশি ভালো লাগত। প্রথম দিন ইজেলের সামনে রঙ তুলি নিয়ে বসবাব সময় ভেবেছিল সামনের ফ্ল্যাটের বৃদ্ধ ভদ্রলোকের পোট্রট আঁকবে। কিন্তু তাই কি হয়? যার স্মৃতি, যার ভালোবাসা অলকের জীবনযাত্রার একমাত্র পাথেয়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই কবিতারই পোর্ট্রেট আঁকল অলক। একটির পর একটি করে চার রকমের চারটি পোর্ট্রেট আঁকল কবিতার। স্টুডিওর চার দেওয়ালে ঝুলানো হল সেই চারটি পোট্রট। রিভলবিং একটা টুলের ওপর বসে অলক ঘুরে ঘুরে দেখত সেই পোর্টেটগুলো আর মনে মনে বলত, কবিতা, তুমি আমার কাছে নেই, পাশে নেই সত্য কিন্তু আমার জীবনের চতুর্দিকে থেকে তুমি আমার সমস্ত সত্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছ। এই বিদেশ বিভুইতে শুধু তুমিই আমাকে চতুর্দিক থেকে রক্ষা করবে।
বেডরুমে একলা একলা ঘুমুতে মন টিকত না। প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত। ছুটে আসত স্টুডিওতে। বাকি রাতটুকু কবিতার চারটি পোর্ট্রেট দেখে কাটাত অলক।
তারপর মাস কয়েকের অক্লান্ত পরিশ্রমে কবিতার একটা লাইফসাইজ পোর্ট্রেট তৈরি করল অলক। জীবনের এত দরদ দিয়ে, এত ভালোবাসা দিয়ে মনের সমস্ত সত্তা, সমস্ত মাধুরী মিশিয়ে পর পর কটি রাত জেগে পোট্রটের ফিনিশিং টাচ দিয়েছিল অলক। যে কবিতাকে নিজের জীবনে, নিজের সংসারে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, তাকেই রংতুলি দিয়ে বরণ করে তুলল শিল্পী অলক, প্রেমিক অলক। এই নতুন পোর্ট্রেটকে দেবীর মর্যাদা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করল নিজের বেডরুমে।
পরবর্তী কিছুকাল অফিস ছাড়া অলক বাকি সময়টুক কাটিয়েছে কবিতার পোট্রেট দেখে, তাদের সঙ্গে কথা বলে, গান গেয়ে, আর পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে। মন কিন্তু এইখানেই স্থির হতে পারেনি, সে আরো এগিয়ে গেছে। মন চেয়েছে সমস্ত কিছু দিয়ে কবিতাকে গ্রহণ করতে, তাকে প্রাণের মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে দেহের প্রতিটি সত্তা, প্রতিটি ইন্দ্রিয় দিয়ে গ্রহণ করতে।