বাসন মাজতে মাজতে পুঁটির মা বেরিয়ে এসেছে। হাসতে হাসতে বলে, হারে, এমন সুন্দর মুখখানা দাড়ি দিয়ে ঢেকে রেখেছিস কেন?
জয়ন্ত মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল, বউ দাড়ি রাখতে বলেছে।
দূর হতভাগা! পুঁটির মা আর দাঁড়ায় না, বাসন মাজতে চলে যায়।
ওর কথায় সবাই হাসেন। হাসি থামতে না থামতেই কৃষ্ণা প্রায় দৌড়তে দৌড়তে ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল। এক মুহূর্তের জন্য জয়ন্তকে দেখেই কেয়ার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, একটু পরে জয়ন্তদাকে পাঠিয়ে দিস। দাদা ডাকছে।
কেয়া কিছু বলার আগেই জয়ন্ত বলল, চন্দনাকে বল আমি চা খেয়েই আসছি।
কৃষ্ণা দাঁড়াল না। যেমন ছুটে এসেছিল, তেমনি ছুটে চলে গেল।
চায়ের কাপটা জয়ন্তর হাতে তুলে দিতে দিতে কেয়া বলল, জানিস দাদা, চন্দনদার বিয়েতে আমাদের ব্রেবোর্নের অনেক মেয়ে আসবে।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করল, অনেক মানে?
অনেক মানে ইন্দিরা আসবে, শিবানী আসবে, মিতা-রিতা আসবে.
কেয়াকে আর এগুতে না দিয়ে জয়ন্ত একটু চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলল, চন্দনদার বিয়েতেই যদি এতগুলো মেয়ে আসে, তাহলে দেবু যেদিন টোপর মাথায় দিয়ে এ বাড়িতে আসবে, সেদিন তো তোদের কলেজে আর কোনো মেয়ে থাকবে না।
দাদা বলে খুব জোরে একটা চীৎকার করেই কেয়া লজ্জায় ঘর থেকে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে গেল।
দুটো দিন কোথা দিয়ে কিভাবে চলে গেল তা ওরা কেউ জানতেও পারলেন না।
বুধবার সকাল থেকে চন্দনদের বাড়িতে চীৎকারচেঁচামেচি, হৈহুঁল্লোড়, হাসিঠাট্টা, দৌড়াদৌড়ি-হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেছে। শুধু চন্দন ছাড়া সবাই ব্যস্ত। জয়ন্তর এক মিনিটের ফুরসত নেই। প্রায় দৌড়ে যাবার পথে চন্দনের মাকে তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করল, কী হল বড়মা?
উনি একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, কি আর হবে! তোর জ্যাঠার হুকুম তামিল করতে করতেই মরে গেলাম।
চন্দনের মা আর দাঁড়ালেন না। কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। জয়ন্ত উপরে যাবার জন্য সিঁড়িতে পা দিতেই হঠাৎ পেছন থেকে কৃষ্ণা ডাকল, জয়ন্তদা, একটু শুনে যাও।
জয়ন্ত পিছন ফিরতেই কৃষ্ণা ওকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বেশ গম্ভীর হয়ে। বলল, এই এক গাল দাড়ি নিয়ে তুমি বরযাত্রী যাবে না।
জয়ন্ত দাড়িতে হাত দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করল, কেন?
কৃষ্ণা আগের মতোই গম্ভীর হয়ে বলল, কেন আবার? আমার ভালো লাগছে না।
কিন্তু..
জয়ন্তকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই কৃষ্ণা বলল, তর্ক না করে যা বলছি শোন।
জয়ন্ত নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
সময় যেন হাওয়ায় উড়ে যায়। চন্দন টোপর মাথায় দিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছে। চারদিকে ভীড়। উত্তেজনা। হঠাৎ জয়ন্তকে পাশে দেখে চন্দন হাসতে হাসতে বলল, এমন সুন্দর দাড়ি কেটে ফেললি?
জয়ন্ত গম্ভীর হয়ে বেশ জোরেই বলল, কি আর করব? বউয়ের কথা তো না শুনে পারি না।
ওর কথায় সবাই হো হো হাসেন।
শাঁখ বাজছে, উলুধ্বনি হচ্ছে, বরণ-আশীর্বাদের পালা চলছে। হঠাৎ কৃষ্ণ জয়ন্তর কানে কানে বলল, তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে।
জয়ন্ত হাসে।
কৃষ্ণা আবার ফিস্ ফিস্ করে বলে, বিয়েবাড়িতে মেয়েদের সঙ্গে বেশি ফাজলামি করবে না।
জয়ন্ত গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করল, করব না?
কৃষ্ণা বেশ জোরের সঙ্গে বলল, না।
নিরুদ্দেশ
আপনিও স্যান্ড ডিউন দেখতে এসেছেন?
ভদ্রলোকের প্রশ্ন শুনে মেয়েটি একটু অবাক হয়। বোধহয় একটু বিরক্তও হয়। রাজস্থানের পশ্চিম প্রত্যন্তের জৈসালমেঢ় জেলার প্রায় পশ্চিম প্রান্তদেশের এই বালির পাহাড়ে! এখানেও আবার একজন বাঙালি! মেয়েটি জবাব দেয়, হ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না।
আমার নাম সুদীপ্ত ব্যানার্জী। কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছি। আপনাকে টুরিস্ট লজএ দেখেছি বলেই…
কিন্তু আমি যে বাঙালি, তা জানলেন কী করে?
সুদীপ্ত একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, গুনগুন করে অতুল প্রসাদের কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জবনে না গাইলে হয়তো জানতে আরো দুএকদিন…
মেয়েটি একটু হেসে বলে, আমি আমার কটেজের মধ্যে পাগলের মতো যা তা সুরে গুনগুন করছিলাম কিন্তু আপনি তা শুনলেন কী করে?
আপনার কটেজের জানালাগুলো খোলা ছিল; তাছাড়া আমি তো আপনার পাশের কটেজেই আছি।
তাই বলুন।
অহেতুক বেশি আগ্রহনা দেখাবার জন্যই সুদীপ্ত বললেন, যাই, একটু ঘুরেফিরে দেখি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখুন!
এমন অবিশ্বাস্য দিগন্ত বিস্তৃত বালির পাহাড় দেখে সুদীপ্ত অবাক হয়। মুগ্ধ হয় বিদায়ী সূর্যের আলোয় এই বালুকাময সাম্রাজ্যের বিস্ময়কর রূপ দেখে বেশ কিছুক্ষণ দেশিবিদেশি টুরিস্টদের ভীড়ে মিলেমিশে ঘুরে বেড়াবার পর উটের পিঠে চড়েও অনেকক্ষণ এদিকওদিক চক্কর দেয়। তারপর জীপ গাড়িগুলোর কাছে উটের পিঠ থেকে নামতেই আবার ওদের দেখা।
সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করে, উটের পিঠে চড়ে ঘুরলেন না?
দুদিন উটের পিঠে চড়ে ঘুরেছি। তাছাড়া আজ শাড়ি পরে এসেছি বলে…
এর আগে আরো দুদিন এখানে এসেছেন?
আসব না? প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনা দেখার জন্যই যে এখানে এসেছি।
বাঃ! খুব সুন্দর কথা বলেছেন। আপনি কী লিটারেচারের ছাত্রী।
না, না, আমি হিস্ট্রি নিয়ে পড়াশুনা করেছি।
এবার সুদীপ্ত একটু হেসে বলেন, আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানতে পারিনি।
সরি! আমার নাম অলকানন্দা সরকার।
উটের পিঠে চড়ে টুরিস্টদের ঘোরাঘুরি পর্ব শেষ হয়েছে। দেশিবিদেশি সব টুরিস্টদের মুখেই স্যান্ড ডিউনের বৈশিষ্ট্য আর সৌন্দর্যের আলোচনা। শহরে ফিরে যাবার জন্য জীপ গাড়িগুলির ড্রাইভাররা হর্ন দিতে শুরু করতেই অলকানন্দা বলে, হর্ন দিচ্ছে : যাই।