তাহলে আমরা কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরেই জামাইয়ের অফিসে যাব।
কোথায় ঘুরবো?
এমনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব।
হেঁটে হেঁটে।
না, না, এই সাইকেল রিক্সায়। তোমাকে পাশে নিয়ে ঘোরার মতো সুযোগ হয়নি তাই…….
দেবকী ডাক্তারের হাতখানা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, আপনি সত্যি বিচিত্র মানুষ।
এজি অফিসের সামনে এসে যখন রিক্সা থামল, তখন ছুটির সময় প্রায় হয়ে এসেছে। দেবকী বলল, আমরা এখানেই অপেক্ষা করি। ও এখুনি বেরুবে।
হ্যাঁ, জামাই একটু পরেই বেরুল। ডাক্তারকে দেখেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। তারপর বাড়ি এসে কত হাসি, কত গল্প।
ডাক্তার মাঝখানে বসে দুহাত দিয়ে দুজনকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার অনেক দোষ ত্রুটি আছে কিন্তু ভাই, আমি তোমাদের দুজনকে সত্যি ভালোবাসি। তোমরা আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না।
জামাই বলে, ডাক্তারদা, জানি আপনি অনেক বড় কিন্তু তবু আপনাকে আমাদেরই একজন মনে করি। আমরা ভুল করে আপনাকে সরিয়ে দিতে চাইলেই আপনি সরে যাবেন কেন? আমরা দুজনেই তো আপনার।
দেবকী বলে, ডাক্তারদা, আপনি যে আমাদের কত প্রিয়, কত আপন, তা কি আপনি বোঝেন না?
ডাক্তার বলে, তা জানি বলেই তো তোমাদেরই কাছে ছুটে এসেছি। আবার দিল্লি থেকে ফেরার পথে আসব। তারপর সময় পেলেই আসব। তোমাদের কাছে না এসে থাকতে পারব না।
সত্যি, ডাক্তার দিলি আসা যাওয়ার পথে সব সময় দুএকদিন এলাহাবাদে কাটিয়ে যায়। যাবেই। কেন ডাক্তারের বার বার মনে পড়ে সেই কটা কথা……
দেবকী, একটা কথা বলব?
বলুন ডাক্তারদা।
শেষ পর্যন্ত একজন চরিত্রহীন ডাক্তারের কাছে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিলে?
দেবকী মাথা নেড়ে বলল, কে বলল আপনি চরিত্রহীন? যে ভালোবাসতে জানে সে কি চরিত্রহীন হয়? যে দেয়া-নেয়ার মধ্যে ভালোবাসা থাকে, তাতে কারুরই চরিত্র যায় না।
ডাক্তার মুগ্ধ হয়ে দেবকীকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়।
দাড়ি
জয়ন্ত ট্রেন থেকে নেমেই মাকে জড়িয়ে ধরল, প্রণাম করল।
মা ওর চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বললেন, হ্যাঁরে, এক গাল দাড়ি রেখেছিস কেন?
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বলল, আমাদের হোস্টেলের সবাই দাড়ি রেখেছে।
এবার জয়ন্ত ওর কাকাকে প্রণাম করতেই বিজয়বাবু ওর বৌদিকে বললেন, জয় আর এখন কচি বাচ্চা নেই। ও এখন আইআইটির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র।
জয়ন্তর মা বললেন, তাই বলে এক গাল দাড়ি রাখবে? এবার ছেলের দিকে ফিরে বললেন, কাল সকালেই দাড়ি কেটে ফেলবি।
হাওড়া থেকে হরিনাভি অনেক দূর। হাওড়া ব্রীজ পার হয়ে বড়বাজারের পাশ দিয়ে ব্ৰেবোর্ন রোড ধরে এগিয়ে ডালহৌসিএসপ্লানেড পিছনে ফেলে পার্ক স্ট্রিটক্যামাক স্ট্রিট সার্কুলার রোড, ওরসদয় দত্ত রোড ঘুরে আমীর আলি এভিন ধরে বেশ খানিকটা যাবার পর গড়িয়াহাটের মোড়।
দীর্ঘ পথ। একে চব্বিশ ঘণ্টা রেলে চড়ে এসেছে, তার উপর বাক্সবিছানাবইপত্তর আছে বলেই ট্যাক্সিতে যেতে হয়। যেতে যেতে অনেক কথা হয়!
মা অনুযোগের সুরে বলেন, হারে জয়, তুই ঠিকমতো চিঠি দিস না কেন বল তো?
প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই তো চিঠি দিই।
মা প্রতিবাদ করেন, কোনো মাসে দুটোর বেশি চিঠি দিস না।
তোমাকে না দিলেও বাবাকে বা কেয়াকে তো দিই।
–ওদের চিঠি দেওয়ানা দেওয়া একই ব্যাপার।
জয়ন্ত হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করে, ও কথা বলছ কেন মা?
মা কিছু বলার আগেই বিজয়বাবু বললেন, ভালো কথা জয়, সামনের বুধবার চন্দনের বিয়ে।
জয়ন্ত আনন্দে ট্যাক্সির মধ্যেই লাফ দিয়ে ওঠে, পরশুই চন্দনদার বিয়ে!
হ্যাঁ। তোর জন্য ওরা সবাই হাঁ করে বসে আছে।
কোথায় কার সঙ্গে চন্দনদার বিয়ে হচ্ছে?
এবার জয়ন্তর মা বলেন, কেয়া বলছিল মেয়েটা খুব ভালো।
জয়ন্ত প্রশ্ন করে, কেয়া চেনে নাকি?
ওদের লেডি ব্রেবোর্নেই তো পড়তো।
কেয়ার সঙ্গেই পড়তো?
না, এক বছরের সিনিয়ার; তবে কেয়ার সঙ্গে খুব ভাব।
জয়ন্ত আবার প্রশ্ন করে, কি নাম মেয়েটির?
রূপশ্রী।
জয়ন্ত হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে, মেয়েটি বুঝি খুব সুন্দরী?
হ্যাঁ।
বিজয়বাবু বললেন, খুব ভালো গান গাইতে পারে।
জয়ন্ত এবার দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রায় আপনমনে বলল, তাহলে ছুটিটা ভালোই কাটবে।
গড়িয়াহাট ব্রীজ পেছনে ফেলে যাদবপুর পার হয়ে গড়িয়ার দিকে এগুতেই জয়ন্ত যেন চোখের সামনে হরিনাভি দেখতে পায়। মনে পড়ে কত টুকরো টুকরো স্মৃতি, আনন্দের ইতিহাস। স্কুলের কথা, ফুটবল ম্যাচের কাহিনি, হেডমাস্টার মশায়ের কাছে বকুনি, চন্দনদাদের বাড়িতে তাস খেলা, দোলের দিন কেয়ার হাতের আবীর নিয়ে কৃষ্ণার সারা মুখে মাখিয়ে দেওয়া। মনে পড়ছে অনীতার বিয়েতে পাল্লা দিয়ে মোঙ্গার চকের দই খাওয়া, রুমা হায়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড করার পর সারা হরিনাভিতে উৎসব আর আনন্দের কথা। আরো কত কি মনে পড়ছে ওর।
ট্যাক্সিটা খুব জোরে মোড় ঘুরতেই মা বললেন, এসে গেছি।
সামনে গোলাপী রঙয়ের স্কুলবাড়ি দেখেই জয়ন্ত যেন আর স্থির থাকতে পারে। এখানকার প্রত্যেকটা গাছপালাধূলোবালির সঙ্গেও ওর আত্মীয়তা। মিত্তির পাড়ার চেহারা অনেক বদলে গেছে। নতুন ছোট ছোট বাড়িতে মাঠ ভরে গেছে। তা হোক। তবু সবকিছু ওর আপন, পরিচিত মনে হয়।
জয়ন্ত ট্যাক্সি থেকে নামতেই কেয়া আনন্দে হাততালি দিয়ে নেচে উঠল; খুশির হাসিতে হাসতে হাসতে গোপালবাবু এগিয়ে এসে দুহাত দিয়ে ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন।
কেয়া ওর দাদার দাড়িতে হাত দিয়ে বলল, তুই দিল্লিতে থাকিস বলে সত্যি সত্যি সর্দারজী হয়ে গেলি?