দেবকী, মুখ নিচু করে বলে, ও দুটোর অভাব কোনদিন এখানে হবে না।
কোনোদিন হবে না?
না কোনদিন হবে না। ডাক্তার খেতে খেতেই দেবকীকে একবার চুমু খায়।
খেয়ে উঠেই ডাক্তার শুয়ে পড়ে। দেবকী ওর পাশে বসে গল্প করে– জানেন ডাক্তারদা, আপনাদের জামাই যেদিন অসুস্থ হয়, সেদিন বাবা খুব ভয়ে ভয়ে আপনার কাছে গিয়েছিলেন।
কেন?
বাবা আপনাকে স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়াতেন। দীর্ঘকাল আপনার সঙ্গে বাবার যোগাযোগ হয়নি। ইতিমধ্যে আপনি বিখ্যাত ডাক্তার হয়েছেন।
তার জন্য ভয়ের কি আছে?
ভয় ছিল টাকাকড়ির ব্যাপারে। টাকা ব্যয় করে জামাইয়ের চিকিৎসা করাবার ক্ষমতা বাবার ছিল না। তাই…
দেবকী কথাটা শেষ করে না।
ডাক্তার জিজ্ঞেস করে, তাই কি?
তাই আপনি যখন টাকা নিলেন না তখন আনন্দে বাবা কেঁদে ফেলেছিলেন। আবার যখন ওষুধপত্র দিলেন তখন বাবার গর্ব দেখে কে?
ডাক্তার হাসে।
দেবকী আবার বলে, সত্যি আপনি ঐভাবে চিকিৎসা না করলে ওকে আমরা বাঁচাতে পারতাম না।
ডাক্তার দেবকীর হাতখানা নিয়ে খেলা করতে করতে বলে, না, দেবকী, ঠিক বললে না। টাকা ব্যয় করলেই কি রুগীকে বাঁচান যায়? এবার ডাক্তার একটু হেসে বলে, একটা কথা তোমাকে বলছি, কিন্তু কাউকে বল না।
না, না, বলব না।
মাস্টারমশায়ের জন্যই তোমাদের বাড়ি যাই কিন্তু জামাইয়ের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি শুধু তোমার জন্য।
আমার জন্য?
একশবার তোমার জন্য?
কেন? আমি কি করলাম?
সেদিন তোমাকে দেখেই মনে হয়েছিল, আহা এই মেয়েটা যদি আমাকে একটু ভালোবাসত তাহলে আমার জীবন ধন্য হত।
কি বলছেন আপনি?
হ্যা দেবকী সত্যি কথাই বলছি। তোমাকে খুশি করার জন্যে মিথ্যে বলছি না এবং বিশ্বাস করো, কোনোদিনই আমি তোমাকে মিথ্যে কথা বলতে পারব না।
দেবকী মুখে কোনো কথা বলে না। বলতে পারে না। শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ডাক্তার বলে, সেদিন তোমাকে দেখেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি প্রাণপণে চেষ্টা করব যাতে দেবকী দুঃখ না পায়। ভগবান আমার মুখ রক্ষা করেছেন। ডাক্তার একটু থেমে বলে, তবে দুচারদিন পরে জামাইয়েরও প্রেমে পড়ে গেলাম। ভারি সুন্দর ছেলে।
দেবকী বলে আপনাকে যে ও কি চোখে দেখে তা বলে বোঝাতে পারব না।
তা আমি জানি, বুঝি।
দেবকী একটু কাত হয়ে বসে ডাক্তারের মাথায় হাত দিতে দিতে বলে, রাত্রে তো ঘুমোননি। এখন একটু ঘুমিয়ে নিন।
না, না, ঘুমোব না।
কেন? ঘুম পাচ্ছে না?
ঘুমালেই তো তুমি চলে যাবে।
না না, আমি চলে যাব না। আপনি ঘুমোন, আমি আপনার কাছেই থাকব। হঠাৎ ডাক্তার পাশ ফিরে শুয়ে দেবকীর কোমর জড়িয়ে ধরে বলে, দেবকী তোমাকে এত কাছে পেয়ে আমি যদি কোনো অন্যায় দাবি করি?
আপনার কোনো দাবিই অন্যায় হবে না।
কি বললে?
বললাম তো, আপনি যা ইচ্ছে দাবি করতে পারেন। আপনার কোনো দাবিকেই আমি অন্যায় মনে করব না।
আনন্দে, উত্তেজনায় ডাক্তার উঠে বসে দুহাত দিয়ে দেবকীকে জড়িয়ে ধরে বলে, সত্যি অন্যায় মনে করবে না?
না, কখনই না।
আমার চরম দুর্বলতা দেখেও রাগ করবে না?
না, ডাক্তারদা, আমি কোনোদিনই আপনার উপর রাগ করব না।
ডাক্তার দেবকীকে নিয়ে আনন্দে উন্মাদ হয়ে যায়।
দুজনে মুগ্ধ হয়ে দুজনকে দেখে। দুজনের মুখেই আত্মতৃপ্তি মাখা খুশির হাসি। মুখে না, শুধু চোখে চোখেই দুজনে কথা বলে। অনেক কথা যে কথা মুখে বলা যায় না, তা শুধু চোখের ভাষাতেই বলা যায়। অনেকক্ষণ এ ভাবেই কেটে যায়।
তারপর দেবকী বলে, কেউ ভাবতেও পারবে না এত বড়ো ডাক্তার আমার কাছে এসে এত ছেলেমানুষী করে।
আমি বুঝি খুব বড়ো ডাক্তার?
হ্যাঁ, তাবে আমার কাছে আপনি শুধু ডাক্তারদা।
ঠিক বলেছ দেবকী! যে বড়ো হয় সেও মানুষ।
আমি তো সেই মানুষটাকেই ভালোবাসি, বড়ো ডাক্তারকে না।
আমি জানি; বড়ো ডাক্তার ভাবলে তুমি এভাবে আমাকে কাছে টেনে নিতে পারতে না
আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করেই ডাক্তার বলে, দেবকী, চা খাওয়াও। তারপর চল আমরা দুজনে জামাইকে নিয়ে আসি।
ডাক্তারের কথা শুনে দেবকী অবাক হয়! বলে, আপনি ওর অফিস যাবেন?
যাব না কেন? আমরা দুজনে ওকে আনতে গেলে খুব মজা হবে।
মজা মানে? ও আপনাকে দেখে চমকে যাবে।
দেবকী চা করে। দুজনে পাশাপাশি বসে চা খেতে খেতে কথা হয়। ডাক্তার বলে, কাল এমন সময় আমি আবার ট্রেনে।
সে কি? আপনি কালই যাবেন?
পরশু যে দিল্লিতে মিটিং আছে। কাল দিল্লি এক্সপ্রেসে যাব
কী আশ্চর্য! তাহলে আপনি এলেন কেন?
কেন এলাম, তা এখনও বুঝতে পারনি?
দেবকী মাথা নেড়ে বলে, না, না, কাল যাওয়া হবে না। এসেছেন যখন তখন দু চারদিন থাকতেই হবে।
কিন্তু পরশু যে আমাকে দিল্লিতে থাকতেই হবে।
তা আমি জানি নে।
যদি তুমি বল, তাহলে ফেরার পথে আবার আসতে পারি।
সত্যি আসবেন?
তুমি বললেই আসব কিন্তু….
আবার কিন্তু কেন?
আমি যদি আবার পাগলামি করি?
যত ইচ্ছে পাগলামি করবেন কিন্তু আপনাকে আসতেই হবে। দেবকী ডাক্তারের হাত দুটো চেপে ধরে বলে।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ডাক্তার দেবকীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি না বললেও আমি আসতাম।
তবে কেন আমাকে ভয় দেখাচ্ছিলেন?
পাগলামি করার পারমিশনটা আগে থেকে আদায়ের লোভে।
লজ্জায় দেবকী উঠে যায়।
সাইকেল রিক্সায় উঠেই ডাক্তার দেবকীকে জিজ্ঞেস করল, জামাইয়ের ছুটি হতে কত দেরি আছে?
দেবকী ঘড়ি দেখে বলল, এখনও ঘন্টাখানেক।