কালকা মেলের বার্থে বসে হুইস্কি খেতে খেতে ডাক্তারের মনে পড়ে দেবকীর কথা।..
.
ডাক্তারদা।
কি? ডাক্তার মুখ না ফিরিয়েই জানতে চায়।
এই হরলিক্সটুকু খেয়ে নিন।
ডাক্তার বিস্মিত হয়ে ওকে দেখে। ওর স্বামী জীবনমরণের মাঝে ভাসছে কিন্তু তবু সে হরলিক্স এনেছে!
দেবকীর মুখে হাসি নেই কিন্তু সারা মুখে তার ঐকান্তিকতার ছাপ! বলল, এখন রাত প্রায় একটা। কখন বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া করবেন, তার তো ঠিক নেই। এটুকু খেয়ে নিন
ডাক্তার একটু হেসে বলে, এই অবস্থার মধ্যেও তুমি আমার জন্য হরলিক্স তৈরি করলে?
তাতে কি হল? আপনার শরীরটাও তো দেখতে হবে।
হুইস্কির গেলাসের দিকে তাকালেই যেন ডাক্তার দেবকীকে দেখতে পায়। কি অপূর্ব শান্ত, স্নিগ্ধ মুর্তি! ঐ মহাবিপর্যয়ের মধ্যেও সে অবিচলভাবে কর্তব্য পালন করেছে। বিপদের মধ্যেও সে মুষড়ে পড়েনি; আবার যেদিন সম্পূর্ণ সুস্থ হল সেদিন আনন্দেও ভেসে যায় নি। ও যেন মাঝ গঙ্গায় আপন মনে ভাটিয়ালি গাইতে বিভোর। জোয়ার না ভাটা–সেদিকে খেয়ালই নেই।
জামাইয়ের ঘরে ডাক্তার ছাড়াও আরো অনেকে। হঠাৎ দেবকী এসে বলল, ডাক্তারদা, একটু হাত ধুয়ে নিন।
না, না, এখন কিছু খাব না
দুমিনিট পরেই দেবকী ঘুরে এল। সবার সামনে নির্বিবাদে বলল, শিগগির হাঁ করুন।
ডাক্তার অবাক হয়ে হাসে। দেবকী ঐ সুযোগেই ওর মুখের মধ্যে লুচি আলুর দম পুরে দেয়।
এ রকম আরো কত টুকরো ঘটনা ডাক্তারের মনে পড়ে। দেবকীর কথা ভাবতে ভাবতে এমন বিভোর হয়ে যায় যে হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিতেও ভুলে যায়। তারপরে হঠাৎ কালকা মেল খুব জোরে ব্রেক কষে থামতেই ডাক্তারের সংবিত ফিরে আসে।
ডাক্তার গেলাসের হুইস্কি শেষ করে আবার ভরে নেয়। আবার ভাবে দেবকীর কথা। জামাইয়ের কথা। খবর না দিয়ে গেলেও কোনো অসুবিধা নেই। ডাক্তারকে কাছে পেলে ওরা দুজনেই খুশি হবে। দারুণ খুশি হবে। পাঁচ পেগ হুইস্কি পেটে যাবার পর ডাক্তার ঠিক করল, এলাহাবাদে নামবে। নামতেই হবে।
কালকা মেল আধ ঘণ্টা দেরিতে এলাবাদ পৌঁছল। ঠিক মহল্লায় পৌঁছে যেতে বেশি সময় লাগল না কিন্তু বাড়িটা খুঁজতে খুঁজতে একটু সময় লাগল। ডাক্তার পৌঁছবার আগেই জামাই অফিস চলে গেছে। দরজা খুলেই ডাক্তারকে দেখে দেবকী আনন্দে খুশিতে চিৎকার করে উঠল, ডাক্তারদা!
দেবকী ওর হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের মধ্যে নিয়েই টিপ করে প্রণাম করল। ডাক্তার দুহাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, খবর না দিয়ে এসে অন্যায় করলাম কি?
দেবকী ডাক্তারের বুকের উপর মুখখানা রেখে বলে, এমন অন্যায় রোজ করতে পারেন না?
রোজ?
হ্যা রোজ। রোজ আপনার কথা ভাবি
কাল সারারাত আমিও তোমার কথা ভেবেছি আর গেলাসের পর গেলাস হুইস্কি খেয়েছি।
তাই কি কাল সারারাতে আমিও ঘুমোতে পারিনি?
কাল রাত্তিরে বুঝি তোমার ঘুম আসছিল না? ডাক্তার আলতো করে হাত দিয়ে দেবকীর মুখখানা তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করে।
ঘুমিয়েছি কিন্তু একেবারে ভোর রাত্রে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
জামাই কিছু বলল না?
ও জানে না।
তাহলে সত্যি তুমি আমাকে ভালোবাসো?
নিশ্চয়ই ভালোবাসি! প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি।
ডাক্তার ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব চাপা গলায় বলল আমিও তোমাকে ভালোবাসি।
জানি।
সত্যি জানো?
হা জানি।
কি করে জানলে?
পরে বলব। এখন বসুন। চা করি।
ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে বাহুবন্ধন থেকে দেবকীকে মুক্তি দিয়ে বলে, হ্যাঁ, চা করো। কতদিন তোমার হাতে চা খাই না।
ডাক্তার কোট খোলে, টাই খোলে, জামার বোতামগুলো খুলে পাখার তলায় বসে।
দেবকী চা আনে। পাশে বসে। বলে, সত্যি, আমি ভাবতে পারছি না। আপনি এসেছে।
কেন?
মনে হচ্ছে, আমি যেন স্বপ্ন দেখছি।
কাল দুপুরেও আমি জানতাম না, আজ দুপুরে তোমাকে কাছে পাব।
কেন? আগের থেকে ঠিক করেননি?
না। ট্রেনে উঠে হুইস্কি খেতে খেতে ঠিক করলাম, দেবকীর কাছে যাব।
খুব ভালো করেছেন। চা খেতে খেতে দেবকী বলে, আপনি স্নান করুন। আমিও চটপট কাজ সেরে নিই। তারপর সারা দুপুর গল্প করব।
তোমার আবার কি কাজ?
একটু রান্না করব।
কেন? তোমার রান্না হয়নি?
হয়েছে, একটু বাকি।
না, না, তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। যা আছে তাই দুজনে ভাগ করে খেয়ে নেব।
না, ডাক্তারদা তা হয় না।
ডাক্তার দেবকীর কাঁধে হাত রেখে বলেন, তাই হবে। তারপর একটু থেমে বলেন, তুমি যা দেবে তাতেই আমার পেট ভরবে।
না, না, আপনার কষ্ট হবে। দেবকী, আমি বিধবার ছেলে। শুধু সিদ্ধ ভাত খেতেও আমার কষ্ট হয় না।
না, দেবকী আর কিছু রান্না করে না। যা ছিল তাই দিয়ে দুজনে খেতে বসে–ডাইনিং টেবিলে না, মেঝেয় আসন পেতে। কোনো চায়নার প্লেটে না, কাঁসার থালায়। দেবকী হাসতে হাসতে বলল, খুব অসুবিধে হচ্ছে তো?
তা একটু হচ্ছে। মা মরে যাবার পর কেউ তো এমন আন্তরিকভাবে যত্ন করে খাওয়ায় নি, তাই অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে গেছে।
দেবকী অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। ডাক্তার আবার বলে, জানো দেবকী আমি নাকি নামকরা ডাক্তার। আমি চেম্বারে বসেই এক একদিন সাত আট হাজার টাকা আয় করি।..
তাই নাকি?
হ্যা দেবকী। সবাই একশ আঠাশ টাকা করে দেয়। পনের কুড়ি জন পেসেন্ট রোজই দেখি কিন্তু কোনো কোনো দিন পঞ্চাশ ষাটজনকেও দেখি। আজ আমার কত কি হয়েছে কিন্তু পাগলের মতো খুঁজে বেড়াই আন্তরিকতা আর ভালোবাসা। তারপর ডাক্তার একটু হেসে বলে, ঐ দুটোর লোভেই তোমার কাছে চলে এলাম।