হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই করুন।
পার্ক সার্কাসের এই বাড়িরে পেসেন্টের ঘরকেই আধুনিক নার্সিংহোমে পরিণত করা হল। কত রকমের মেসিন আনা হল। কার্ডিয়াক পেসেন্ট দেখাশুনা করে এমন নার্সদেরও আনা হল। ঘণ্টায় ঘণ্টায় দেখছেন ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান। এছাড়া ডাক্তার বার বার আসছেন ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকছেন।
বাহাত্তর ঘণ্টা কেটে গেল। সবার চোখেই আশার আলো। রাত সাড়ে বারোটার পর ডাক্তার বাড়ি যাবার সময় বলে গেলেন, হার্টের কন্ডিশন অনেকটা স্টেবিলাইজ করেছে। অবস্থা এইরকম থাকলে ভয়ের কিছু নেই।
রাত পৌনে তিনটের সময় হঠাৎ সিস্টারের ফোন, স্যার এখুনি চলে আসুন।
ডাক্তার পনের মিনিটের মধ্যে ছুটে যায়।
হ্যাঁ, হঠাৎ সেই ব্যথা, সিরিয়াস সেই ব্যথা। ডাক্তার যুদ্ধ করে, যুদ্ধ করে নার্স কিন্তু না, ওরা হেরে গেল। চারদিকে ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গেই এ বাড়িতে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে এল। ডাক্তারের পায়ের উপর মুর্চ্ছা গেলেন পেসেন্টের স্ত্রী আর বড়ো ভাই। ডাক্তার চোখে অন্ধকার দেখে। হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাবার উপক্রম। সামলে নেয় সিস্টার।
ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মৃত্যু অনেক দেখিছি কিন্তু এই পেসেন্টের মৃত্যুতে এমন শক্ পেলাম যে তখন গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরার মতো অবস্থা আমার নেই। সিস্টার কাছেই সি. আই. টি. রোডে থাকত। ও আমাকে ওর বাড়িতেই নিয়ে গেল।
তারপর?
ছোট্ট দুখানা ঘরের ফ্ল্যাট। আশা আর ওর দাদাবৌদি থাকেন। কখনও কখনও দেশ থেকে মা আর ছোটো ভাই আসে। ঘরে ঢুকলেই বোঝা যায়, অত্যন্ত সাধারণ অবস্থা কিন্তু আশার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে যান ডাক্তার।
ডাক্তার বলল, বোধহয় ঘন্টাখানেক আশার ওখানে ছিলাম কিন্তু ঐটুকু সময়ের মধ্যেই বুঝলাম, আশা মানুষকে ভালোবাসতে পারে, মানুষের সুখদুঃখ বোঝে।
তারপর প্রায় বছর খানেক আশার সঙ্গে ডাক্তারের দেখা হয় না। সেদিন রুগীরা চলে যাবার পরও ডাক্তার চেম্বারে বসে আছেন এক বন্ধুর অপেক্ষায়। একলাই। স্টাফদের ছুটি দিয়েছেন। হঠাৎ টেলিফোন…….
ইয়েস।
স্যার আমি আশা।
আশা। মানে সিস্টার আশা?
হা স্যার।
কেমন আছ? কাজকর্ম কেমন চলছে?
এমনি ভালো আছি, তবে কাজকর্ম কখনও ভালো, কখনও খারাপ।
তুমি কি কোনো নার্সিংহোমে চাকরি করতে ইন্টারেস্টেড?
হা স্যার।
ঠিক আছে, আমি দেখছি।
স্যার, আমি কিন্তু নিজের জন্য টেলিফোন করিনি।….
হ্যা বল, টেলিফোন করলে কেন?
স্যার আপনার শরীরটা বোধহয় ঠিক নেই, তাই না?
হ্যাঁ, খুব টায়ার্ড কিন্তু তুমি কি করে জানলে?
সেদিন কন্টিনেন্টাল নার্সিংহোমে আপনাকে দূর থেকে দেখেই……
তুমি ওখানে ছিলে নাকি?
হা স্যার, আমি পাশের কেবিনে ছিলাম কিন্তু আপনাকে দেখেছি। দেখেই মনে হল, আপনার রেস্ট দরকার।
সত্যি ডাক্তার বড়ো ক্লান্ত। হবে না কেন? এত রুগী সামলান কি সহজ ব্যাপার? খাওয়া দাওয়ার কোনো ঠিক নেই। ঘুম? না, বহুকাল ভালো করে ঘুমুতে পারে না কিন্তু কেউ তো ডাক্তারকে বলেনি, তুমি ক্লান্ত, তুমি বিশ্রাম নাও।
মুগ্ধ ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারে না। কয়েক মুহূর্ত পরে বলে, ঠিক বলেছ আশা, আমার রেস্ট দরকার।
অন্তত দশপনের দিনের জন্য কোথাও চলে যান স্যার।
অত দিন বাইরে থাকা মুস্কিল কিন্তু পাঁচসাত দিনের জন্য যেতে পারি। তবে একলা গেলে তো সারাদিন শুধু হুইস্কি খাব; তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
আমি? আশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, তুমি।
আপনি সিরিয়াসলি বলছেন স্যার?
হ্যা আশা, আমি সিরিয়াসলি বলছি। তুমি কদিন দেখাশুনা করলে আমি সত্যি সুস্থ হব
আপনি যদি তাই মনে করেন তাহলে নিশ্চয়ই যাব স্যার।
ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, আশাকে নিয়ে চলে গেলাম গোপালপুর অন-সী। ওবেরয় পান বীচএ আগের থেকেই ঘর বুক করা ছিল। সত্যি বলছি জার্নালিস্ট, আমাকে আশা কত শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, তা সেবার দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সেবাযত্নের কথা তো বাদই দিচ্ছি।
আমি একটু হেসে বললাম, সো, ইউ হ্যাড এ ওন নাইস টাইম।
একশবার! মানসিক, দৈহিক সব দিক থেকেই মহানন্দে ছিলাম।
আশা এখনও কলকাতায় আছে? আমি হাসি চেপে প্রশ্ন করি
হ্যাঁ।
এখনও মাঝে মাঝে গোপালপুরেব সমুদ্রে দুজনে একসঙ্গে স্নান করো?
বছরে একবার নিশ্চয়ই যাই! তাছাড়া দুএক মাস অন্তর দুএকদিনের জন্য কোথাও কোথাও আশাকে নিয়ে চলে যাই।
তুমি কি আশাকে ভালোবাসো?
নিশ্চয়ই ভালোবাসি।
আর কাকে ভালোবাসো?
অনেককেই আমি ভালোবাসি।
অনেককে?
হ্যা অনেককে। যারা আমাকে ভালোবাসে, আমিও তাদের ভালোবাসি।
আমি হেসে বলি, নট এ ব্যাড থিওরি।
ডাক্তার আমার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরায়। পর পর দুনিটে টান দেবার পর বলল, এইতো দিল্লি আসার পথে দুদিন এলাহাবাদে কাটিয়ে এলাম।……
এলাহাবাদে?
হ্যাঁ। দেবকী আছে না?
কোনো দেবকী?
মাস্টারমশায়ের মেয়ে। যার স্বামীর… …
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ছে। তুমি তাহলে সত্যি এলাহাবাদ গেলে?
গেলে মানে? দিল্লি আসা-যাওয়ার পথে সব সময় এলাহাবাদ নামি! না নেমে পারি না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আমি হেসে জিজ্ঞাসা করি, তোমার হৃৎপিণ্ডের এক টুকরো কি ওখানেও জমা রেখেছ?
ইয়েস।
গুড গুড।
তাহলে শোনো।… …
আগে মনে পড়েনি। মনে পড়লে নিশ্চয়ই চিঠি লিখত, দেবকী, মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের কাজে দিল্লি যাচ্ছি। মাঝ পথে এলাহাবাদ। তাই ভাবছি নেমেই পড়ব দুএক দিনের জন্য। তোমাদের দুজনের সঙ্গে আড্ডা দেবার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারছি না। কিন্তু না, মনে পড়েনি। ডাক্তার এত ব্যস্ত থাকে যে অনেক কথাই মনে পড়ে না। রুগীদের চিন্তায় এত ব্যস্ত থাকে যে অন্য কোনো কিছু চিন্তার অবকাশ পায় না। মনে পড়ল কালকা মেলে উঠে। ডাক্তার মনে মনে অনুশোচনা করে চিঠি না দেবার জন্য। চিঠি না দিয়ে যাওয়া উচিত নয় কিন্তু মনে মনে বড়ো ইচ্ছে করছে দেবকীর কাছে যেতে।