ডাক্তার হেসে বলে, সময় কোথায়?
ওসব জানি না। আপনাকে আসতেই হবে।
ডাক্তার ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, আসতেই হবে?
একশ বার আসতে হবে।
ডাক্তার সুজিতের দিকে তাকিয়ে বলে, জামাই, শুনছ তোমার বউয়ের কথা?
ও ঠিকই বলছে।
ডাক্তার বলে, তাহলে একবার নিশ্চয়ই এলাহাবাদ যেতে হবে।
এর দুচার দিন পরেই অপরূপা হাসতে হাসতে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল, মাস্টারমশায়ের বাড়িতেও কি আরেকটা অপরূপার দেখা পেলে?
ডাক্তার অবাক হয়ে বলে, তার মানে?
মানে দেখে শুনে মনে হচ্ছে ওখানেও একটা অপরূপা পেয়েছ। তা না হলে বিনা পয়সার চিকিৎসায় এত উৎসাহ কেন?
যাদের বেশি পয়সা নেই, যারা শুধু আমার উপর নির্ভর করে, সেরকম সব পেসেন্টদেব বাড়িতেই আমি বার বার যাই।
পয়সা পেলে কেন যাবে না?
শুধু পয়সার জন্য আমি চিকিৎসা করি না।
কেন তুমি কি রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী?
সন্ন্যাসী কেন হব?
তাহলে মাস্টারমশায়ের কাছ থেকে কিছু নিলে না কেন?
কারণ উনি আমার মাস্টারমশাই।
পেসেন্ট তো ওর জামাই। সে তো চাকরি বাকরি করে?
ডাক্তার হেসে বলে, ও বাড়ি থেকে টাকা নিইনি বলে কি তোমার কোনো কষ্ট হচ্ছে?
কষ্টের কথা তো বলি না। তোমার প্রাপ্য তুমি নেবে না কেন?
ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারে না। মুখ নিচু করে একটু ভাবে। বলতে পারে না, অপরূপা, আমি যদি আমার উচিত প্রাপ্য নিতাম তাহলে তোমার বাবা-মাকে পথের ভিখারী হতে হত। তোমারও বিয়ে হত কি না, তা ভগবান জানেন। ডাক্তার বলতে পারে না তার মায়ের কথা, দ্যাখ বাবা, পয়সার লোভে চিকিৎসা করবি না। যদি তোর খাওয়া পরার কষ্ট না থাকে, তাহলে কোনো গরিব লোকের কাছ থেকেই পয়সা নিস না। দেখবি ওদের আশীর্বাদে তোর আয় দশগুণ বেড়ে যাবে।
মার কথা ভাবতে গিয়েও ডাক্তারের চোখে জল আসে। ডাক্তার হুইস্কির গেলাসটা পাশে সরিয়ে রেখে আমাকে বলে, জানো জার্নালিস্ট, মার কথা বর্ণে বর্ণে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে আমার জীবনে। একটা গরিব পেমেন্টের টাকা ছেড়ে দিলে দশটা বড়োলোকের বাড়ির পেসেন্ট হাতে আসে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, জার্নালিস্ট। আমি পদে পদে এর প্রমাণ পাই। ডাক্তার একটু হেসে বলে, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি কি ভবিষ্যতে বেশি পাবার লোভে এদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছি না? পর মুহূর্তে মনে হয়, না, না, তা কেন হবে? আমি তো আমার মাতৃ আজ্ঞা পালন। করছি।
তাই তো।
ডাক্তার গেলাসে এক চুমুক দিয়ে বলে, অপরূপা এত তাড়াতাড়ি তার অতীত ভুলে গেল যে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। তাছাড়া ও যত পেয়েছে, তত ওর লোভ বেড়েছে। আমি সত্যি এসব ভাবতে পারি না।
তুমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করেছ?
বহুবার, বহুভাবে। ডাক্তারের গেলাস খালি হয়। আবার ভরে নেয়। বলে, স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক এমনই অদ্ভুত যে একজনের সব মহত্বক্ষুদ্রতাই অন্যের কাছে ধরা পড়ে। তাই প্রতিদিন প্রতি পদক্ষেপে ওর এত ক্ষুদ্রতা এত দৈন্য দেখি যে আমি আর ওকে ভালোবাসতে পাবি না; বরং ঘেন্না করি। আমি আস্তে আস্তে ওর থেকে দূরে সরে যেতে যেতে আজ কতজনের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিযেছি।
এবার আমি একটু হেসে বলি, অনেকের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছ?
হ্যাঁ, অনেকের কাছে। তারপর ডাক্তার একটু হেসে বলে, ছাত্রজীবনে অনেকের সঙ্গে প্রেম করেছি কিন্তু চরিত্রহীন ছিলাম না। একবার নীলিমা আমাকে কি বলেছিল জানো?
কি?
বলেছিল, ছেলেদের সঙ্গে একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা হলেই তারা অনেক কিছু দাবি করতে শুরু করে কিন্তু তুমি বেশি কিছু দাবি কর না বলেই তোমার সঙ্গে এত প্রাণখুলে মিশতে পারি।
শুনে আমি হাসি!
ডাক্তার হুইস্কির গলাসটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে একটু ম্লান হাসি হাসে আপনমনে। তারপর সে যেন স্বগতোক্তি করে, নদীর জলে বাধা দিলেই সে দশদিক দিয়ে এগুবার চেষ্টা করে; এটাই জলের ধর্ম। মানুষেরও তাই স্বভাব। সে একজনের কাছে প্রাণ ভরে ভালোবাসা পেলে দশজনের কাছে ভালোবাসার ভিক্ষা চাইবে না, কিন্তু ঐ একজনের কাছে হতাশ হলে সে বিপথগামী হবেই।
আমি বলি, হা ডাক্তার, অনেকের জীবনেই এই ঘটনা ঘটে।
ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, জার্নালিস্ট, এখন অন্যের কথা বাদ দাও। আমার কথাই শোন।
পার্ক সার্কাসের এক তরুণ ডাক্তারের টেলিফোন পেয়েই ডাক্তার ছুটে গেল। ভদ্রলোক বয়স বেশি না, বড়ো জোর চৌত্রিশপঁয়ত্রিশ। কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার। বিলেতেই থাকেন। বিয়ে করেছেন বছর পাঁচেক আগে। একটি মেয়ে হয়েছে। তার বয়স বছর দেড়েক। ভদ্রলোকের স্ত্রীকে এককালে কলকাতার নানা মঞ্চে শ্যামার ভূমিকায় দেখা গেছে। সবচাইতে ছোটো ভাইয়ের বিয়ের জন্য লন্ডন থেকে এসেছেন। বিযেও বেশ ভালোভাবেই হয়েছে। বৌভাতও খুব সুষ্ঠভাবে হল। চার ভাই মহা খুশি। খুশি ওদের বৃদ্ধা মা ও বাড়ির সবাই।
দুদিন পর ভোরের দিকে হঠাৎ বুকে ব্যথা। অসহ্য ব্যথা! অবশ হয়ে যাচ্ছে এক দিক। সঙ্গে ঘাম। ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান ছুটে এলেন। একটু দেখেই তার মুখের চেহারা বদলে গেল। ওর টেলিফোন পেয়েই ডাক্তার ছুটে গেলেন। হ্যাঁ, যা সবাই আশঙ্কা করেছিলেন, তাই।
বড়ো ভাই ডাক্তারকে বললেন, ভাইকে সুস্থ করার জন্য যা দরকার তাই করুন। ডাক্তার নার্স ওষুধনার্সিংহোম, কোনো ব্যাপাবেই আপনার দ্বিধা করার প্রয়োজন নেই।
ডাক্তার বললেন, এ পেসেন্টকে নার্সিংহোম নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। তাই বাড়িতেই সবকিছু করতে হবে।