কেন? অবাক হয়ে আমি প্রশ্ন করি।
দুর্ঘটনাই বলতে পারে। কিন্তু এখন কলকাতার বাজারে আমার বেশ সুনাম। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার হেসে বলে, চরিত্রের ব্যাপারে নয়, ডাক্তার হিসেবে।
তারপরই ডাক্তার গম্ভীর হয়। বলে, কিন্তু লোকে তো চরম বিপদে পড়েই আমাকে ডাকে।
সে তো একশ বার।
তাই পেসেন্টদের বাড়ির অবস্থা খারাপ দেখেলেই আমার বাবার অসুখের সময়ের কথা মনে পড়ে যায়। আমি কিছুতেই ওদের কাছ থেকে টাকা নিতে পারি না।
আমি হেসে বলি, এই মন আছে বলেই তো তুমি এত বড়ো হয়েছ।
ডাক্তার একটু ম্লান হাসি হেসে বলে, একটা ঘটনা শোন। সেদিন শনিবার। রাত তখন গোটা নয়েক হবে। চেম্বারের রুগী দেখা শেষ করে দুটো একটা পেমেন্টের কিছু রিপোর্ট দেখছিলাম। হঠাৎ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন
চিনতে পারছ বাবা?
চেহারা অনেক বদলে গেছে কিন্তু তবু ডাক্তার চিনতে পারে, হ্যাঁ স্যার, চিনতে পারব কেন?
না বাবা, সব ছাত্র তো চিনতে পারে না। তাছাড়া তুমি এখন বিরাট ডাক্তার।
ওকথা বলবেন না স্যার। আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে কিছু শিখেছি মাত্র। বলুন স্যার, কি ব্যাপার?
বাবা, পাড়ার ডাক্তার বললেন, জামাইয়ের নাকি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
সে কি?
হ্যা বাবা। বৃদ্ধ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, অন্য ডাক্তারের কাছে যাবার তো সাহস নেই, তাই তোমার কাছে ছুটে এলাম। তুমি যদি একটু দয়া……।
কী বলছেন আপনি? আমি এখুনি যাচ্ছি।
দুএক মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার মাস্টারমশায়ের সঙ্গে গাড়িতে রওনা হয়।
গাড়ি মাস্টারমশায়ের বাড়ির সামনে থামতেই ডাক্তার ড্রাইভাবকে বলে, তুমি বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে এসো। আর অপরূপাকে বলে দিও, আমি এখানে আছি।
পেসেন্টের ঘরে পৌঁছবাব সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তার যুদ্ধ শুরু করে। পাড়ার ডাক্তারবাবু ওকে সাহায্য করেন। দণ্টা তিনেক পরে যুদ্ধের প্রথম পর্ব শেষ হয়। ডাক্তার এবার একটু হেসে মাস্টারমশায়ের মেয়েকে বলে, দিদি, এবার এক কাপ চা খাব।
এখুনি দিচ্ছি ডাক্তারবাবু।
ডাক্তারবাবু না, আমি তোমার দাদা। বাবার ছাত্র দাদাই হয়, তাই না?
ডাক্তারের কথা শুনেই এই দুর্যোগের মধ্যেও আনন্দে মাস্টারমশায়ের মেয়ের চোখে জল আসে।
চা খেতে খেতেই পাড়ার ডাক্তারবাবু কিছু নির্দেশ দেন। পাড়ার ডাক্তারবাবু চলে যাবার পর ডাক্তার মাস্টারমশাইকে প্রেসক্রিপসন দিয়ে বলেন, শুধু এক নম্বর ওষুধটা কিনবেন। আর সব অষুধ আমার কাছে আছে। তারপর ডাক্তার মাস্টারমশায়ের মেয়েকে বলে দে কখন কোন ওষুধ খাওয়াতে হবে।
ডাক্তার যখন ও বাড়ি থেকে রওনা হয়, তখন রাত প্রায় দেড়টা। মাস্টারমশাই ডাক্তাবের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিতে যান। ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে হেসে বলে, কি করছে স্যার?
ডাক্তার আর কথা বলতে পারে না। গাড়ি চালাতে শুরু করে।
ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ এক নার্সিংহোম থেকে ডাঃ ঘোষ ফোন করেন ডাক্তারকে তুমি একটু আসবে এখুনি? আমার একটা পেমেন্টের ব্যাপারে তোমার ওপিনিয়ন….
ডাক্তার একটু হেসে জানতে চায়, পুরুষ না মেয়ে পেসেন্ট?
পুরুষ।
শালা, মেয়ে পেসেন্ট হলে তো কখনও আমাকে কনসাল্ট করার কথা মনে পড়ে না।
ডাঃ ঘোষও হাসেন। বলেন, ওরে শালা, তুমি তো আমার বউয়ের মেডিক্যা এ্যাডভাইসার। আচ্ছা, তাড়াতাড়ি এসো।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসছি।
ডাক্তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে নিজেই চালিয়ে চলে যায়। আধঘন্টার মধ্যেই নার্সিংহোম থেকে ডাক্তার বেরিয়ে পড়ে। সোজা চলে যা মাস্টারমশায়ের জামাইকে দেখতে। মাস্টারমশায়ের মেয়ে দরজা খুলেই দিয়েই অবাক আপনি? এত ভোরে?
ডাক্তার বলে, আগে বলুন, আমার পেসেন্ট কেমন আছেন?
এখনও ঘুমুচ্ছেন।
ডাক্তার পেসেন্টকে দেখে। আবার ইসিজি করে। আরো কত কি! একটা ইনজেকশন দেয় ডাক্তার। তারপর আবার ইসিজি, আবার ব্লাড প্রেসার দেখে। খুব মন দিয়ে নাডি স্পন্দন পরীক্ষা করে বার বার। স্টেথো কানে দিয়ে বুক পরীক্ষা করে বহুক্ষণ ধরে।
ঘরখানা অত্যন্ত ছোটো। তাই ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় পা দিয়েই একৗ হেসে মাস্টারমশায়ের মেয়েকে বলে, চায়ের জল চাপিয়েছো?
সেও হাসে। বলে, চায়ের জল ফুটছে।
তাহলে এক্ষুনি পাব?
নিশ্চয়ই। এবার মাস্টারমশায়ের মেয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে, কেমন দেখলে দাদা?
ডাক্তারের মুখে হাসি লেগেই আছে। বলে, আমাকে দেখেও বুঝতে পারছো না?
একটু ভালো, তাই না?
একটু না, বেশ ভালো।
পাশের ঘরে বসে চা খাবার সময় মাস্টারমশাই ডাক্তারকে জিজ্ঞেস কবলেন, অত রাত্তিরে গিয়ে আবার এই ভোরবেলায় না এসে একটু বেলায়..
সাড়ে চারটের সময় একটা নার্সিংহোমে একজন পেসেন্টকে দেখতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে ঘুরে গেলাম।
মাস্টারমশায়ের মেয়ে বলে, তাহলে তো ঘন্টা দুয়েকের বেশি ঘুম হয়নি।
ডাক্তার হেসে বলে, না, তা হয়নি।
দিনে কি ঘুমুবার সুযোগ হবে?
বছর খানেকের মধ্যে তো দিনে ঘুমুবার সুযোগ হয়নি। জানি না আজ কি হবে।
কিন্তু এভাবে পরিশ্রম করলে তো শরীর ভেঙে পড়বে।
বিধবা মা অনেক দুঃখ কষ্টের মধ্যে আমাকে মানুষ করেছেন। এই কষ্টে আমার শরীর ভেঙে পড়বে না।
দিন পাঁচেক পর মাস্টারমশায়ের জামাইয়ের অবস্থা সত্যি ডাক্তারকে ঘাবড়ে দিয়েছিল কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত সামলে যায়। তারপর থেকে আস্তে আস্তেই অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।
এই তিন সপ্তাহে ডাক্তারের সঙ্গে এ বাড়ির সবার সম্পর্কও অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। মাস্টারমশায়ের স্ত্রী আর ঘোমটার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন না। মাস্টারমশাযের সেই কৃপাপ্রার্থীর মনোভাব আর নেই। জামাই সৃজিত ডাক্তারের প্রায় বন্ধু হয়ে গেছে। হাসতে হাসতে সুজিত বলে, এখন মনে হচ্ছে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসে অসুস্থ হওয়ায় ভালোই হয়েছে। অসুস্থ না হলে তা তো আপনাকে পেতাম না। মাস্টারমশায়ের মেয়ে দেবকী বলে, আমরা এলাহাবাদ ফিরে গেলে আপনাকে একবার আসতেই হবে।