মিসেস চৌধুরী দুহাত দিয়ে ডাক্তারের মুখখানা ধরে কপালে একটু চুমু খেয়ে বললেন, তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোটো করব না। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তোমার খ্যাতি যশ সারা জগতে ছড়িয়ে পড়ুক।
ডাক্তার হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিয়ে বলে, এককালে বহু বড়ো বড়ো জমিদার সর্বস্বান্ত হয়েছে মদ আর রক্ষিতাদের কল্যাণে। বহু লোক সর্বস্বান্ত হয়েছে মামলামোকদ্দমা করে। কিন্তু আমাদের দেশে সব চাইতে বেশি লোকের সর্বনাশ হয়েছে রোগের জন্য।
আমি বলি, ঠিক বলেছ ডাক্তার।
ডাক্তার হেসে বলে, অন্যদের কথা আর কি বলব। আমার বাবা আর দিদির চিকিৎসা করতে গিয়েই মা পথে বসেন। ডাক্তার একটু থামে। তারপর বলে, তাই তো মা আমাকে
অনেক দুঃখকষ্টের মধ্যেও ডাক্তারি পড়ান।
ডাক্তার অধিকাংশ সময়ই বর্তমানের কথা বলে। অতীতকে নিয়ে টানাটানির অভ্যাস বিশেষ নেই। কিন্তু আজ ডাক্তার শুধু ফেলে আসা দিনগুলোর কথাই বলছে!
ডাক্তার হাসতে হাসতে বলে, মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় যেমন পড়াশুনা করেছি, তেমনি প্রেম করেছি। দুটোই করেছি প্রাণভরে। এমন একটা সময় এসেছিল যখন নীলিমা আর জয়ার মধ্যে টাগঅবওয়ার শুরু হল আমাকে নিয়ে। ঠিক এই সময় রিইউনিয়নে আলাপ হল শিখাদির সঙ্গে।
কে শিখাদি?
আরে, ডাঃ মৈত্রের স্ত্রী।
তারপর?
তারপর মাকে জগন্নাথ দর্শন করাবার জন্য পুরীতে গিয়ে হঠাৎ শিখাদির সঙ্গে দেখা।
.
আরে ডক, তুমি?
এখন তো সবে ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র। কেন আর ডক বলে লজ্জা দিচ্ছেন?
আজ না হোক কাল তো পাশ করে ডাক্তার হবে।
যদি ফেল করি?
এসব কথা ছাড়া। বেড়াতে এসেছ?
মা জগন্নাথ দর্শন করতে এসেছেন।
শিখাদি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কাকে দর্শন করতে এসেছ?
ডাক্তারের মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে যায়, আপনাকে।
আমি শুনেই হাসি। বলি, তারপর?
ডাক্তারও হাসে। বলে, ডাঃ মৈত্র ওঁর ডাক্তার বন্ধুদের সঙ্গে বিয়ার খেতেন, ফ্ল্যাশ খেলতেনআর আমি শিখাদিকে নিয়ে পুরীর সমুদ্রে স্নান করতাম।
আর?
শিখাদি আমাকে আর মাকে নিয়ে কোনার্ক গেলেন। মা একটু দেখেই বসে রইলেন। আমি আর শিখাদি খুব ঘুরলাম।
তারপর?
কলকাতা ফেরার দুএক সপ্তাহ পর ডাঃ মৈত্রের বাড়ি ফোন করলাম।… …
শিখাদি অভিমানের সুরে বললেন, তুমি তো অদ্ভুত ছেলে!
কেন?
এতদিন পরে তুমি ফোন করছ?
কী করব বলুন। পড়াশুনা নিয়ে বড়োই ব্যস্ত ছিলাম তাছাড়া হসপিট্যাল ডিউটিও এমন পড়েছে যে… …
আচ্ছা থাক। অত লেকচার না দিয়ে চলে এসো।
এখন?
হ্যাঁ, এখন।
আপনার ওখানে যাতায়াত করতে করতেই তো আমার হসপিট্যাল ডিউটির সময় হয়ে যাবে।
সময় না থাকে ট্যাক্সিতে চলে এসো।
ট্যাক্সি! ট্যাক্সি চড়ার পয়সা কোথায়?
আচ্ছা, আচ্ছা, আমি ভাড়া দেব। তুমি চলে এসো।
ডাক্তার আবার এক চুমুক হুইস্কি খায়। বলে, ভালো ছাত্র, ভালো ডাক্তার বলে ডাঃ মৈত্রের সঙ্গে শিখাদির বিয়ে দেন ওর বাবা। হসপিট্যাল আর প্রাইভেট প্রাকটিশ করে ডাঃ মৈত্র যেটুকু সময় পেতেন তা তাস খেলেই কাটিয়ে দিতেন। স্ত্রীর প্রতি কোনো কর্তব্য করাই সময় ছিল না তার।
আমি সিগারেট টানতে টানতে ডাক্তারের কথা শুনি।
ডাক্তার আবার এক চুমুক হুইস্কি খায়। আবার বলে, শিখাদি অত্যন্ত প্রাণবন্ত ছিলেন। তাই এই স্বামীর পাল্লায় পড়ে তিনি সত্যি পাগল হয়ে উঠেছিলেন। আমার সঙ্গে শিখাদির কোনো দৈহিক সম্পর্ক ছিল না কিন্তু উনি আমাকে সত্যি ভালোবাসতেন।
তাই নাকি?
হা জার্নালিস্ট! শিখাদি আমাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন এবং ওরই তাগিদে আমি বামন হয়েও চাঁদে হাত দিতে সাহস করেছি।
তার মানে?
শিখাদি অমন করে আমার পিছনে না লাগলে আমি সত্যি বিলেত যেতাম না। ডাক্তার একটু থেমে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। তারপর বলে, আমার বিলেত যাবার জাহাজ ভাড়া শিখাদিই দিয়েছিলেন।
আচ্ছা!
হ্যা জার্নালিস্ট। কিন্তু বিলেত থেকে ফিরে এসে আর শিখাদিকে পেলাম না।
কেন?
শিখাদি আত্মহত্যা করেছিলেন।
কেন?
শিখাদি স্বামীর অবজ্ঞা অনেক সহ্য করেছিলেন কিন্তু যখন শুনলেন অমন ভাবভোল স্বামীরও আরেকটা সংসার আছে, তখন উনি সিন্ধান্ত নিতে দেরি করেননি।
সত্যি, কি দুঃখের কথা।
কলকাতার অনেক ডাক্তারের কাছেই শিখাদির নামে অনেক কুৎসা নোংরামী শুনতে পাবে। অনেকে বলে, শিখাদি বছর দুই আমার সঙ্গেই সংসার করেছেন।
এটা তো আমাদের জাতীয় চরিত্র।
সে যাই হোক, শিখাদির কথা আমি কাউকে বলি না কিন্তু তোমাকে বলছি, ওর জন্য আমি এমন একটা শূন্যতা বোধ করতাম যা তোমাকে বোঝাতে পারব না।
ঠিক বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করতে পারি।
ডাক্তার একটু হেসে বলে, অপরূপাকে প্রথম দিন দেখেই আমি চমকে উঠেছিলাম।..
কেন?
অনেকটা শিখাদির মতো দেখতে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তাইতো ওকে আমি বিয়ে করলাম।
খুব ইন্টারেস্টিং তো!
অপরূপাকে বিয়ে করার আরো একটা কারণ ছিল।
কী?
প্রথম দিন অপরূপার বাবাকে দেখতে গিয়েই বুঝলাম, ওরা ধনী নয়। আরো দু’চারদিন যাবার পর বুঝলাম, মিঃ চৌধুরীর অসুখের খরচ চালাবার মতো অর্থের সংস্থান ওদের নেই।
আমি ফি না নিলেও অন্য ব্যয় তো আছে।
তা তো বটেই।
তাই দেখলাম, অরূপাকে যদি বিয়ে করি, তাহলে ঐ পরিবারের অনেক উপকার হবে
শুনে আমার ভালো লাগে। বলি, ডাক্তার তোমাকে কি আমি এমনি এমনি ভালোবাসি।
ডাক্তার যেন আমার কথা শুনেও শোনে না। বলে, আমি অপরূপাকে ভরিয়ে দিয়েছি সব কিছু দিয়ে। ওর কোনো ইচ্ছাই আমি অপূর্ণ রাখিনি। কিন্তু ও আমাকে এমন দুঃখ দিয়েছে যে আজ আমি অপরূপার পাশে শুতেও ঘেন্না বোধ করি।