আমি কলকাতা এলে ঠিক এর বিপরীতটা হয় না। হওয়া সম্ভব নয়। আমি দুচার দিনের জন্য আসি নানা কাজকর্ম নিয়ে। ডাক্তারও ব্যস্ত। মাঝরাতেও নিস্তার নেই। হঠাৎ কেউ রুগীর বুকে ব্যথাটা বাড়লেই হুড়মুড় করে উঠে নিজেই গাড়ি চালিয়ে ছুটবে। আমার ডাক্তার কার্ডিওলজিস্ট! হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। তবুও আমার ডাক্তারের আজ্ঞা হবেই। কখনও চেম্বারে, কখনও বা ক্লাবে ও হোটেলে। সৌভাগ্যক্রমে হাতে খুব সিরিয়াস রুগী না থাকায় ডাক্তার নিজেই ফিয়াট নিয়ে বেরুবে। তারপর আমাকে নিয়ে চলে যাবে কোথাও। শান্তিনিকেতন, ডায়মন্ডহারবার বা ঝাড়গ্রামের ওদিকে। একদিন দেড়দিন প্রাণ ভরে দিয়ে আবার কলকাতা ফিরে আসি।
এই আড্ডার ব্যাপারে আমার আর ডাক্তারের মধ্যে এক অলিখিত চুক্তি আছে। আমি ওর কাছে অসুখবিসুখের ব্যাপারে কিছু জানতে চাই না; ডাক্তার ও আমার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করবে না। এ ছাড়া বিশ্ব সংসারের যাবতীয় সব সৎ ও অসৎ ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হয় আমাদের। তবে ডাক্তারের প্রেমের কাহিনি শুনতেই আমার সবচাইতে ভালো লাগে। এ ব্যাপারে ডাক্তারের ঔদার্য সীমাহীন। ডাক্তার হাসতে হাসতে বলে, সেকালে ভালো ভালো কবি ছিলেন বলে অর্জুনের প্রেম কাহিনি নিয়ে কবিতা রচনা হয়েছে। একালে যদি তেমন ভালো কবি থাকতেন তাহলে আমাকে নিয়েও অমন অনেক কাব্য রচনা হতে পারতো।
আমি হাসি।
ডাক্তার এক চুমুক হুইস্কি খেয়ে বলে, না, না, ভাই, হাসির কথা নয়। রবি ঠাকুর শরৎচন্দ্র বেঁচে থাকলেই দেখতে আমাকে নিয়ে কত কি লেখা হয়েছে।
সব যুগেই সব দেশের মানুষই প্রেম করেছে। ভবিষ্যতেও করবে কিন্তু ভারতবর্ষে প্রেম করা যেন মহাপাপ। এ মহাপাপ সবাই করে, সবাই লুকোয়। ডাক্তার সত্যি ব্যতিক্রম। ভালো ছাত্র বলে ডাক্তারের খ্যাতি ছিল মেডিক্যাল কলেজে। এডিনবরা থেকে এম. আর সি পি পাশ করেছে প্রায় অনায়াসে। তারপর এক অস্ট্রিয়ান যুবতীর মোহ ডাক্তারকে টেনে নিয়ে যায় ভিয়েনায়। কিছুদিন এই সুন্দরীকে নিয়ে দানিযুব খাল, ওপেরা হাউস, নাইট ক্লাব স্পেলডিড ফাস্ট ডিস্ট্রিকেটর অলিগলিতে ঘোরাঘুরি করতেই ডাক্তার আরো একটা পরীক্ষা দেয়। আশ্চর্য ব্যাপার। পাশও করল। সেদিন ডাক্তার ঐ মেয়েটিকে নিয়ে ইভএ নেচেছিল সারারাত।
মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময়ও ডাক্তারের জীবনে একাধিক মেয়ে এসেছে। সহপাঠিনী নীলিমা, ফাইনাল ইয়ারের জয়া, নার্স কৃষ্ণা ছাড়াও কিছুকালের জন্য ডাঃ মৈত্রের স্ত্রীর সঙ্গেও বড়ো বেশি জড়িয়ে পড়েছিলেন। বিলেত থেকে ফিরে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই ডাক্তার বিয়ে করে অপরূপাকে। অপরূপা সত্যি অপরূপা। রূপে, গুণে। অপরূপাকে বিয়ের পিছনেও একটু কাহিনি আছে।
.
ডাক্তার সবে বিলেত থেকে ফিরেছে। বিশেষ কেউই চেনে না। কিছু পুরনো বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর কেউ নাম জানে না! রুগী আসে কম। কল আসে আরো কম। তবে হ্যাঁ, রুগী এলে ডাক্তার জানপ্রাণ লড়িয়ে দেয় তাকে সুস্থ করার জন্য। যে বাড়িতে কল পায়, ডাক্তার সেখানে বার বার যায় রুগী দেখতে। টাকা? না, না, ঐ একবারই নেয়, বার বার নয়। ডাক্তারের এই আগ্রহ, সঠিক চিকিৎসা, হাসিখুশি মুখখানা আর অমায়িক ব্যবহার রুগীর বাড়ির সবাইকে মুগ্ধ করে। ডাক্তারের খ্যাতি ছড়ায়।
রাত তখন এগারোটা। ডাক্তার শুয়েছে। হঠাৎ টেলিফোন পেয়েই ছুটল ল্যান্সডাউনে। মিঃ চৌধুরীর অবস্থা সত্যি সঙ্কটাপন্ন। ডাক্তার পর পর দুটো ইনজেকশন দিয়ে বার বার হার্ট আর পালস্ দেখে। ঘণ্টাখানেক পরে আবার ইনজেকশন। যুদ্ধ চলল সারারাত। ভোরের দিকে ডাক্তার বাড়ির সবাইকে বললেন, মনে হয় এখন মিঃ চৌধুরী ঘুমুবেন। এখন আমি যাচ্ছি। যদি দরকার হয় সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবেন।
ফি?
না, না, এখন কিছু দিতে হবেনা। আগে উনি সুস্থ হয়ে উঠুন। তারপর ওঁর হাত থেকেই আমি আমার ফি নেব।
ডাক্তারের কথা শুনে বাড়ির সবাই অবাক। এ ডাক্তার সত্যি বিচিত্র। রুগীদের চিন্তায় এর ঘুম হয় না, স্বস্তি পান না। যখন তখন রুগী দেখতে আসেন। প্রয়োজন মনে করলে বার বার আসেন, থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দিনে, রাতে।
তারপর একদিন মিঃ চৌধুরী সম্পূর্ণ সুস্থ হলেন। নিজেই এলেন ডাক্তারের কাছে। বললেন, আপনি না হলে সত্যি আমি বাঁচতাম না। আপনার ঋণ কোনদিনই শোধ দিতে পারব না। তবু বলুন, কত দেব।
ডাক্তার হেসে বলে, না, না, আপনাকে কিছু দিতে হবে না।
তাই কি হয়? আপনি বলুন, কী দেব?
ডাক্তার মুখ নিচু করে একটু ভাবে
মিসেস চৌধুরী স্বামীর পাশেই ছিলেন। উনি বললেন, এতদিন আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করে তোত বুঝতে পেরেছেন আমরা অত্যন্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত। আপনাকে যা দেওয়া উচিত তা দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই কিন্তু কিছু না দিলে তো আমরাও শান্তি পাব না।
ডাক্তার এবার হেসে বলনে, সত্যি কিছু দেবেন?
ওঁরা স্বামীস্ত্রী প্রায় একসঙ্গেই বললেন, নিশ্চয়ই।
ডাক্তার দ্বিধা করে। বলে, কিন্তু যদি বেশি চেয়ে ফেলি তাহলে……
মিসেস চৌধুরী বললেন, আমরা জানি আপনি এমন কিছু চাইবেন না যা আমরা দিতে পারবো না।
এবার ডাক্তার যেন একটু সাহস পায়। বলিষ্ঠ হয়। বলে, ইচ্ছা করলে আপনারা দিতে পারবেন কিন্তু তা কি আমাকে দেবেন?
স্বামীস্ত্রী এবারও একসঙ্গে বলেন, নিশ্চয়ই দেব।
তাহলে অপরূপাকেই দিন।
আনন্দে, খুশিতে মিঃ চৌধুরী দুহাত দিয়ে ডাক্তারকে টেনে নিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, তুমি যে আমার কি উপকার করলে বাবা, তা পরমেশ্বরই জানেন।