উপেক্ষা আর অনাদরের মধ্যেও পিতৃহীন বালক বড়ো হয়। খুঁড়িয়েই পার হয় কটা বছর। সোমনাথ তখন চোদ্দ বছরের কিশোর। ছবিটা তখন অনেক বেশি স্পষ্ট। বুকের ব্যথা প্রায় অসহ্য। মনের মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টা আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। বাড়ি থেকে পালাল সোমনাথ।
মাস্টারবাবু একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, কটা বছর বড়ো কষ্টে কাটালাম। কত জনে কত বদনাম দিয়েছে। কেউ বলেছে চোর; কেউ বলেছে পকেটমার। মারধরও খেয়েছি বহুবার।
আমার অজ্ঞাতসারেই আমার মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোয়, ইস!
ঘুরতে ঘুরতে এলাম নাসিক। সৌভাগ্যক্রমে এক বৃদ্ধ মিঠাইওয়ালার কৃপা লাভ করলাম। ঐ বৃদ্ধের দোকানেই থাকি; কাজকর্মও করি। ওবই দয়ায় আবার পড়াশুনা শুরু করলাম।
তারপর?
স্কুলের গণ্ডী পার হতে না হতেই বৃদ্ধ মারা গেলেন। ওব ছেলে বোম্বেতে চাকরি করত। তাছাড়া মিষ্টির দোকানের কাজও জানত না। ব্যবসা তুলে দিল। আমিও ওরই সঙ্গে বোম্বে চলে এলাম।
তারপর?
এটাওটা করতে করতেই রেলের চাকরি পেয়ে গেলাম। এখানে এলেন কেন? মাস্টারবাবু একটু শুকনো হাসি হেসে বলেন, একদিন হঠাৎ কোন্নগর স্কুলের এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল চার্চ গেটের ধারে। কথায় কথায় তার কাছে মার অনেক কীর্তি শুনলাম।
মাস্টারবাবু আর বলতে পারেন না। থামেন। আমি অবাক হয়ে ওকে দেখি।
একটু পরেই উনি আবার শুরু করলেন, বন্ধুর কাছে ঐসব শুনে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল! তাই মনে মনে ঠিক করলাম, এমন জায়গায় যাব যেখানে কোনো পরিচিতের মুখ কোনদিন দেখব না। মাস্টারবাবু হঠাৎ একটু হেসে বললেন, অনেক খোঁজখবর, অনেক চেষ্টা করে এখানে এসেছি।
হঠাৎ নজর পড়ে, রেল লাইনের ধার দিয়ে কৃষ্ণা আসছে। মাস্টারবাবুকে বললাম, দেখুন দেখুন, কৃষ্ণা আসছে।
নিশ্চয় চা নিয়ে আসছে।
ও জানল কেমন কবে, আমরা এখানে আছি?
প্রায় রোজ বিকেলের দিকেই আমি এই কালভার্টের উপর বসে থাকি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, এ জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। অনেকদিন রাত্রেও আমি এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি।
কৃষ্ণা এখানে এসেও চা দিয়ে যায়?
হ্যাঁ
মাস্টারবাবুর সংসারে ফ্লাক্স নেই কিন্তু কেটলি আছে। কৃষ্ণা সেই কেটলির চারপাশে জড়িয়েছে ছোট একটা তোয়ালে। সে মাস্টারবাবুকে আর আমাকে গরম চা খাওয়াবেই। আমি দেখে হাসি। মনে মনে খুশি হই, মুগ্ধ হই ওর আন্তরিকতা আর ভালোবাসা দেখে।
কৃষ্ণা চা খায় না। আমরা দুজনে চা খাই। দুটোএকটা কথাবার্তার পরই ও মাস্টারবাবুকে বলে, মাস্টারবাবু, আজ আমি পড়বো না।
কেন? মাস্টারবাবু প্রশ্ন করেন।
কৃষ্ণা তার কালো হরিণচোখ ঘুরিয়ে বলে, আজ আমি পড়বো কেন? আজ তো বাবুজির সঙ্গে কথা বলবো।
মাস্টারবাবু হেসে বলেন, বাবুজির সঙ্গে তো আমি গল্প করব। তুমি কেন পড়বে না?
কৃষ্ণা মাথা নেড়ে বেণী দুলিয়ে বলে, না, না, আজ আমি জরুর বাবুজির সঙ্গে গল্প করবে।
আমি না হেসে পারি না। আমি ওর মাথা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলি, না, না, আজ তোমাকে পড়তে হবে না। আজ আমি আর তুমি গল্প করব।
আর মাস্টারবাবু?
মাস্টারবাবু আজ সারা রাত স্টেশনে ডিউটি দেবে।
আমার কথা শুনে ও হাসিতে ফেটে পড়ে। মাস্টারবাবুও হাসেন।
কৃষ্ণা কেটলি থেকে আবার চা ঢেলে দেয়। আমরা চা খাই। গল্প করি। হাসি। তিনজনে একসঙ্গে ফিরে আসি। কৃষ্ণা কোয়ার্টারে যায়। আমরা দুজনে স্টেশনে বসি। ঘোরাঘুরি করি। কত কথা শুনি, কত কথা বলি। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে ভারতবর্ষের পশ্চিম দিগন্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। রতিলাল অফিস ঘরে আলো জ্বেলে দিয়ে কোয়ার্টারে যায়। ফিরে আসে খাওয়াদাওয়ার পর। আমরা তখনও গল্প করি।
রতিলাল তাগিদ দেয় কিন্তু আমরা উঠতে পারি না। গল্পের নেশায় এমনই মশগুল যে। উঠব উঠব করেও উঠতে পারি না। শেষে ছুটে আসে কৃষ্ণা। আমরা আর দেরি করি না।
খাওয়ার আগে, খাওয়ার পর আবার গল্প। তিনজনেই যেন গল্পের নেশায় মাতাল হয়ে গেছি। কোয়ার্টারের বাইরে চাটাই বিছিয়ে গল্প করতে করতে ভুলে যাই শুক্লা তৃতীয়ার রাতের মেয়াদ আর বেশি নেই। হঠাৎ মাস্টারবাবু উঠে কোয়ার্টারে যান। বোধহয় বাথরুমে। কৃষ্ণা হাত দিয়ে আমার মুখখানা ওর দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করে, আচ্ছা বাবুজি, আমার মাস্টারবাবু খুব ভালো না?
উনযৌবনার কথা শুনে মুগ্ধ হই। বলি, হা, তোমার মাস্টারবাবু খুব ভালো লোক।
ওদের সান্নিধ্যে দুটো দিন কাটিয়ে দিলাম।
.
পরের দিন সকালের ট্রেনেই চলে যাব। শেষ রাত্তিরের দিকে শুতে এলাম। হঠাৎ মাস্টারবাবু প্রশ্ন করলেন, আমি কি ভুল করলাম?
না, না, ভুল করবেন কেন? ঠিকই করেছেন। একটু থেমে বললাম, ভগবান দুহাত দিয়ে যাকে এগিয়ে দিয়েছেন তাকে বুক পেতে গ্রহণ করার মধ্যে কোনো অন্যায়, কোনো ভুল নেই।
পরের দিন সকালে সকলের চোখেই জল। গাড়ি এসে থামল এই অখ্যাত অপরিচিত হল্ট এ।
কৃষ্ণা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলল, বাবুজি, এর পরের বার এসে তুমি আমাকে বাঙালিদের দেশে নিয়ে যাবে। আমি আরো ভালো বাংলা শিখবে, আরো ভালো খানা বানাবে।
বিদায়বেলা বিচ্ছেদ বেদনার মধ্যেও আমি হাসি। বলি, তোমার মাস্টারবাবু নিশ্চয়ই তোমাকে বাঙালিদের দেশে নিয়ে যাবে। ওটা তো তোমারও দেশ।
রতিলাল গামছা দিয়ে চোখের জল মুছে বলল, হ্যাঁ বাবুর্জী, ও আপনাদেরই মেয়ে আছে।
গাড়ি ছেড়ে দিল। আমি লাফিয়ে ট্রেনে উঠলাম।
ডাক্তার
ডাক্তার আমার চাইতে বয়সে বড়ো হলেও বন্ধু। বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দিল্লিতে এলেই ডাক্তার আমাকে ফোন করবে। আমার শত কাজ থাকলেও আমাকে ছুটে যেতে হবে ইন্দ্রপুর এস্টেটের ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের উপর তলার ঘরে। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যে রাত্তির। সময়ের কোনো ঠিক নেই। ডাক্তার এ ব্যাপারে প্রায় নাদির শা। হুকুম অমান্য করা চলবে না। একদিন, দৃদিন, তিন দিন। ডাক্তার যে কদিন দিল্লি থাকবে সে কদিনই আমাকে ডিউটি দিতে হবে। এর অন্যথা ও বরদাস্ত করে না; আমিও ভাবতে পারি না।