–কত দূরে? কোথায় যেতে হবে?
অল্প কথায় ঠিকানা আর পথনির্দেশ জানিয়ে দিল। ‘মেঘচুম্বিত অ্যাপার্টমেন্টস্’ দক্ষিণ কলকাতাতে। বেশি দূরে নয় যোধপুর পার্ক থেকে। সদ্যনির্মিত অ্যাপার্টমেন্ট হাউস। সব ফ্লাটে এখনও কোয়াপারেটিভ মেম্বারদের শুভাগমন ঘটেনি। ওর ফ্ল্যাট নং এইট/টোয়েন্টি। অর্থাৎ আটতলায় বিশ নম্বর দরজা। লিফট আছে। স্বয়ংক্রিয়। সর্বদা চলন্ত। লোডশেডিং-নির্ভর নয়। ‘পশ’ এলাকা।
–এবার বল কখন আসছ? কবে?
–শুভস্য শীঘ্রং। ধর কাল।
–সরি! কাল সন্ধ্যায় আমি এনগেজড।
–সন্ধ্যায় নয়। দুপুরে। দুটোয় ‘অফ’ হচ্ছি, ধর আড়াইটেয়। তাহলে?
–তুমি কি কলেজে পড়াও?
অসাবধানে কথাটা বলে ফেলেছেন। তৎক্ষণাৎ প্রতিপ্রশ্ন করেন, তোমার নাম কি মালিনী?
–অল রাইট! অল রাইট! প্রফেসর সলিল মিত্র। বেলা দুটোয় যখন তুমি ‘অফ’ হচ্ছ, তখন আড়াইটেতেই–অ্যাসুমিং তুমি দমদম মতিঝিল বা বি. টি. রোডের ‘স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিট্যুটে’ ‘অফ’ হচ্ছ না! তাহলে আধঘণ্টাই যথেষ্ট, দুপুরবেলা।
–ডোর-বেল বাজালে যে সাড়া দেবে তাকে কী বলব? ‘মালিনীকে’ ডেকে দিতে?
–ঠিক দুটো ত্রিশে হলে আমি নিজেই দোর খুলে দেব।
–আর যানজটে যদি পৌনে তিনটে বেজে যায়?
–দেখবে, খোলা দরজায় দুটি কপাট দুহাতে ধরে মালিনী পনেরো মিনিট অধীর আগ্রহে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে, আর্যপুত্রের প্রতীক্ষায়।
এ কী হল? এ কী হচ্ছে? তিন কুড়ি পাড়ি দেবার ব্রাহ্মমুহর্তে এ কোন জাতের ধাষ্টামো? নলচের আড়ালটা কার দৃষ্টিপথে দিচ্ছেন? নিজের বিবেক? পূজা-সংখ্যার জন্য একটা নভেলেটের প্লট অনুসন্ধানে এই জাতের অভিসার? ন্যাকামির একটা সীমা থাকবে তো?
কিন্তু তেলাপোকার টানে মোহগ্রস্ত কাঁচপোকার মতো, উনি যেন চলেছেন নিয়তি নির্দিষ্ট সর্বনাশের পথে। পরিচয় জানতে আর কিছু বাকি নেই। আলট্রা-মডার্ন সফিস্টিকেটেড কল-গ্যের্ল। মালটিস্টোরিড অ্যাপার্টমেন্টে আপয়েন্টমেন্ট করে খদ্দের ‘বসায়’। একবার শয্যাসঙ্গিনী হবার দক্ষিণামূল্য কত? কিন্তু উনি তো মেয়েটিকে স্পর্শমাত্র করবেন না?
উনি তো শুধু জানতে চান–কেন? কেন? কেন?
ত্রিশ বছর বয়স, একশ ছেষট্টি সে. মি. উচ্চতা। ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স : 36 24-37, ডিভোর্সি এবং চাকুরিজীবী এসবই শোনা কথা–হেয়ার-সে। কিন্তু মেয়েটি কথাবার্তা, পত্ররচনায় তো যাকে বলে, ‘এ-ওয়ান’। টেলিফোনে ইংরেজিতে সামান্যই আলাপচারি হয়েছে, কিন্তু তার ভিতরেই মনে হয়েছে, মেয়েটি কনভেন্ট-লালিতা। এমন একটি সর্বগুণান্বিতা রমণীরত্ন কী হেতুতে বেছে নিল এই জীবিকা? কেন সে কারও সহধর্মিণী নয়, কেন সে নয় কারও ‘মা’? দেশকে, দশকে, আগামী প্রজন্মকে সে কী দিয়ে যাচ্ছে? শুধুই ইন্দ্রিয়জ কামনা-বাসনার রিরংসা-পুরীষ?
–কেন?–কেন?–কেন?
০৫. মেঘচুম্বিত অ্যাপার্টমেন্ট
০৫.
পরদিন গাড়ি নিয়ে কলেজে এলেন না। উনি চান না, ঐ ‘মেঘচুম্বিত অ্যাপার্টমেন্ট’ হাউসের সামনে রাস্তার উপর গাড়িটা পার্ক করতে। কলেজ থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যখন ওখানে পৌঁছলেন তখনও নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়নি। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে স্বয়ংক্রিয় লিফটে উঠে এলেন আটতলায়। অধিকাংশ ফ্ল্যাটই খালি। বস্তুত, মিস্ত্রিরা এখনও কাজ করছে এখানে-ওখানে। নিচে অবশ্য তমাধারী দারোয়ান বসে ছিল। চোখ তুলেও দেখল না।
এইট/টোয়েন্টি নম্বরচিহ্নিত দরজা। একটা নেমপ্লেট : এস সোন্ধী।
কল-বেল বাজাতে গিয়ে ইতস্তত করলেন কিছুটা। মিনিটতিনেক। তার ভিতর একবার মাত্র লিফটটা উপর থেকে নিচে নামল। একজোড়া চড়ুই পাখি রেলিঙে এসে বসে বিহঙ্গভাষে নিজেদের মধ্যে কী-যেন বলাবলি করল। এ-ছাড়া চরাচর নিস্তব্ধ। মনেই হচ্ছে না, এটা জনাকীর্ণ কলকাতা শহর।
প্রফেসর তালুকদার মরিয়া হয়ে কল-বেলটার গলা টিপে ধরলেন।
তৎক্ষণাৎ ম্যাজিক-আইয়ের ও প্রান্তে এগিয়ে এল একটা কৌতূহলী চোখ।
সে চোখে কাজল-পরা আছে কি না বোঝা গেল না, কিন্তু ভারি পাল্লাটা পাঁচ সেন্টিমিটার আন্দাজ ফাঁক হল। তারপর আটকে গেল সেফটি ক্যাচ-এ।
ও-প্রান্ত থেকে বামাকণ্ঠে প্রশ্ন হল : হুম ডু ঝু ওয়ান্ট প্লিজ?
–মালিনী, মালিনী সোন্ধী! ডাজ শি লিভ হিয়ার?
–ইয়েস অ্যান্ড নো। বাট হুম শ্যুড আই অ্যানাউন্স?
–মিত্র। এস. মিত্র।
দরজাটা খুলে গেল : ‘একী, আর্যপুত্র যে!’
উনি প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর পিছনে বন্ধ হয়ে গেল ইয়েল-লক সদর দরজা। এবং করিডোরে জ্বলে উঠল জোরালো বাতি।
অসতর্ক অধ্যাপকের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল : আপনি?
মেয়েটি–-মহিলাটিই বলা উচিত–চলতে শুরু করেছিল। এ কথায় থমকে থেমে গিয়ে বললে, তুমি কি. ট্রিলজি লিখবে বলে মনস্থির করে ফেলেছ?
–ট্রিলজি! মানে?
–প্রথম খণ্ডে নায়িকা ‘আপনি’, দ্বিতীয় খণ্ডে ‘তুমি’, তৃতীয় ও শেষ খণ্ডে আজকাল তোমাদের কলেজে ছেলে-মেয়েরা যা করে : ‘তুই-তোকারি’!
–আমি কলেজে পড়াই কে বলল?
–কে আবার? তুমি! এস! এখানে দাঁড়িয়ে কথা কইলে বাইরের প্যাসেজে শুনতে পাওয়া যায়। তা হঠাৎ ‘আপনি’ বলে থেমে গেলে যে? তুমি কি আগে আমাকে কোথাও দেখেছ?
চলতে চলতে ওঁরা এসে বসলেন ড্রইংরুমে। প্রকাণ্ড ঘর, কিন্তু ভালভাবে সাজানো নয়। ড্রইংরুমটা বড়, বেশ বড়, কিন্তু সোফা-সেটি কিছু নেই। খানকয় ফোন্ডিং চেয়ার। একটা ক্যানভাসের ইজিচেয়ার। দেওয়ালে ছবি, ক্যালেন্ডার একটাও নেই। মায় সিলিঙে ফ্যান পর্যন্ত নেই। অথচ দেওয়ালে সিন্থেটিক এনামেলের মোলায়েম প্রলেপের কুহক।