“কৌতূহল যদি পুরোপুরি মিটে গিয়ে থাকে তাহলে এই কাগজখানার দাহকার্য সম্পন্ন কর–দুজনের ইস্তাক্ষরেরই সহমরণে সদগতি লাভ হবে। সেজন্যই তোমার চিঠির উল্টোদিকে এই বিপরীত-বিহার। আর কৌতূহলের ছিঁটেফোঁটা যদি এখনো বাকি থাকে তাহলে নিচের নম্বরে রিং করতে পার। উপন্যাসের ভাল প্লটই পাবে। গ্যারান্টিড। তোমার প্রকাশক তোমাকে কী হারে রয়্যালটি দেন আমার জানা নেই কিন্তু আমি কি আমার ‘প্রকাশক’-এর কাছে বিনামূল্যে বিকাবো? তাতেও রাজি–যদি কবি কালিদাসের শর্তটা মেনে নাও। অর্থাৎ যদি প্রকাশের আগে আমিই হই তোমার পাণ্ডুলিপির প্রথম পাঠিকা।
ইতি—
মালিনী।”
সন্দেহ দোলায়-দোলায় দোলায়মানা কুয়াশার যে রহস্যময় আবরণ একটা ছিল, ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল তা।
না, H.D.31–হ্যাঁ তাই, ‘মালিনী’ ওর নাম নয়, কায়দা করে ছদ্মনাম নেওয়া, কাব্য করে–যেহেতু, কবি কালিদাসের নামে প্রচলিত গল্পে তাঁর প্রথম শ্রোতার নাম : মালিনী।
মোট কথা মেয়েটি জীবনসঙ্গী খুঁজছে না আদৌ।
সহজ, সরল, ভদ্র ভাষায়: ‘রূপোপজীবিনী’।
হয়তো ‘পত্রমিতালী’র সম্পাদক জানেন, অথবা জানেন না, আন্দাজ করেন–আপত্তি করেন না।
কিন্তু ঐ মেয়েটি–ঐ জাতের পাঁচজন ‘অড-উইমেন আউট’ই–’পত্রমিতালী’ পত্রিকাকে দেহবিজ্ঞপ্তির উপাদান হিসাবে গ্রহণ করেছে। জীবনসঙ্গীর সন্ধানী হলে ‘বিবাহিত প্রৌঢ়’ মানুষটাকে সে আদৌ পাত্তা দিত না।
কিন্তু যদি সত্যিই ও পত্ৰবন্ধুত্বের অভিলাষী হয়? না, তা হতে পারে না। সেক্ষেত্রে নিজের ‘ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স’ ওভাবে বিজ্ঞাপিত করত না।
তাছাড়া ওর চিঠির খাঁজে খাঁজেও যে যৌন ইঙ্গিত! ‘প্রকাশক’ কথাটাতে ‘সিঙ্গল কোট মার্ক দিয়ে বিশেষ ব্যঞ্জনা দিতে চেয়েছে। চিঠির কাগজের উল্টো দিকে লেখাটাকে বলেছে : ‘বিপরীত-বিহার’। এবার সিঙ্গল-কোট দেয়নি। অর্থাৎ সরলার্থই গ্রাহ্য : বিপরীত প্রান্তে ভ্রমণ।
মানছেন, সব মানছেন, তবু নিজের কাছে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, মেয়েটি ‘সাধারণী’ নয়, রাজনটীরা যেমন চৌষট্টি কলার মধ্যে বিশেষ করে শিখত পত্ররচনা, জাপানের ‘গেইসা’রা যেমন বাক্যের টানাপোড়েনে একটা কুহকীমায়া রচনায় বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্তা, ও-ও যেন তাই। আর সেজন্যই বিকোবার আগে ‘মূল্যের’ প্রশ্নটা কায়দা করে তুলেছে। ‘মূল্য’ অর্থাৎ ‘অর্থমূল্য’। কিন্তু সেজন্য কি ওকে দোষ দেওয়া যায়? সলিল মিত্র তো নিজে থেকেই বলেছিলেন, মনোমত একটা গল্পের প্লট পেলে ওকে যথাযোগ্য সম্মানদক্ষিণা দেবেন। এক্ষেত্রে ‘ফিজ’ আর ‘সম্মানদক্ষিণার’ ফারাক কী? দুটোই তো রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের প্রতিশ্রুতির পরিমাপের মূল্যায়নে।
তবে হ্যাঁ, চিঠি শেষ করার আগে সে আরও একটি প্রস্তাব দিয়েছে। অর্থাৎ যদি তাকে কবি কালিদাসের মালিনী হবার অধিকার দেওয়া যায়। যদি সলিল মিত্র উপন্যাসটি লিখে প্রকাশক বা পূজা সংখ্যার সম্পাদকের হাতে তুলে দেবার আগে পাণ্ডুলিপিটি ওকে সর্বপ্রথম পড়তে দেন!
এ কথা ও কেন বলল? ও তো সলিল মিত্রের কোনো লেখা পড়েনি। মালিনী যেমন ছদ্মনাম, এ-তরফের ‘সলিল মিত্র’ও তো তাই।
তাহলে? প্রথম দর্শনে প্রেম হয়। বাস্তবে হোক না হোক, রোমিও জুলিয়েটে হয়। তাই বলে প্রথম পত্রপাঠে প্রেম! একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না, স্যার?
কালিদাসের ‘মালিনী’ সম্বন্ধেই বা আমরা কতটুকু জানি? সেটাও তো কল্পকথা।
কবি বিনিদ্র রজনীর পরিশ্রমে কাব্য রচনা করতেন–শকুন্তলা, কুমারসম্ভব, মেঘদূতম–আর ঘোর-ঘোর প্রাগূষা লগ্নে রাজার প্রাসাদে ফুল-জোগানোর পথে থমকে থেমে যেত মালিনী, এসে বসত ওঁর সদর দরজার সামনে। পাখির কূজন তখনো জাগেনি বনদেবীর শাখায় শাখায়। বলত, পড়ুন, আর্যপুত্র, কাল রাত্রে কাহিনী কোন পথে মোড় নিল?
কালিদাস শুকতারাকে সাক্ষী রেখে সেই ঘৃতপ্রদীপ-জ্বলা আধো-অন্ধকারে আবৃত্তি করে শোনাতেন সদ্য রচিত দশ-বিশটি শ্লোক।
হয়তো বা তা রতিরঙ্গরসের অকপট বর্ণনা।
দেহদর্পণে দেহাতীতের প্রতিচ্ছায়া।
ইতিহাস বলেনি, লাজে-রাঙা মালিনী মাঝপথে বাধা দিয়ে বলে উঠেছিল কিনা–ক্ষান্ত হন আর্যপুত্র! এ বর্ণনা স্বয়ংপাঠ্য, আবৃত্তির যোগ্য নয়। অন্তত, ঘৃতপ্রদীপজ্বলা জনান্তিকে–
ইতিহাসে একথাও বলেনি, প্রত্যুত্তরে কবি কালিদাস ফুৎকারে ঘৃতপ্রদীপ শিখাকে নির্বাপিত করে প্রায়ান্ধকারে কামোদ্দীপিতা মালিনীর লজ্জাহারণ করেছিলেন কিনা।
তাছাড়া ইতিহাস এ কথাও বলেনি যে, কবিপত্নী কক্ষান্তরে নিদ্রাগতা।
তিনি দীর্ঘদিন এবং দীর্ঘতর রাত্রি শয্যালীনা–রতিরঙ্গসুখবঞ্চিতা।
জানবার যেটুকু ছিল জেনেছেন, কিন্তু তাই বলে কৌতূহল কি ফুরিয়ে গেছে? এমন আমন্ত্রণ পাওয়ার পর?–কবি কালিদাসের ভাষায়–যাকে বলে ‘বিবৃত জঘনাং কো বিহাতুম সমর্থঃ?’
টেলিফোনটা তুলে নিয়ে ডায়াল করলেন।
–হ্যালো? …ইয়েস স্পিকিং! হুম ড্যু য়ু ওয়ান্ট প্লীজ?
তালুকদার ইংরেজিতে বললেন, ‘মালিনী’ নামে একটি মেয়ে…
–ডিয়ার মি! কবি! বলুন কীভাবে আপনার সেবা করতে পারি? হ্যাঁ, আমি মালিনীই বলছি।
–তুমি আমাকে একটি প্লট দিতে প্রতিশ্রুত…
–শুধু প্লট? বেণীর সঙ্গে মাথা দিতেও যে প্রস্তুত! তোমারে যা পারিব না দিতে সে কার্পণ্য চিরকাল আমারেই রহিবে বঞ্চিতে! বল, কবি! কবে, কখন শুভাগমন ঘটবে?