কিন্তু হয়তো ওঁর এক নম্বর অনুমানটি ভুল। বিবাহের বন্ধনে ও নিজেকে বাঁধতে চাইছে না আদৌ। চাকরি করছে, একলা থাকছে, সিনেমা-থিয়েটার-জলসা-রেস্তোরাঁ, দিব্যি ফুর্তিফাৰ্তা করছে। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। কর্তার বাক্যবাণে বিদ্ধ হতে হয় না, ওর বান্ধবীর দিকে সে কী দৃষ্টিতে তাকায় তা নজর করতে হয় না, মায় ওর শার্টে বোতাম লাগাবার পরিশ্রমটুকুও সইতে হয় না।
কিন্তু!
হ্যাঁ, একটা বিশেষ চাহিদা ওর পক্ষে মেটানো মুশকিল। আবশ্যিক জৈবিক চাহিদা। এই পুরুষশাসিত সমাজে। উইমেন্স লিব-এর ধ্বজাধারিণীরা চাকুরিক্ষেত্রে বৈসাম্য রাখতে দেননি। ‘পোস্টম্যান’কে ‘পোস্টওম্যান’ এবং ‘চেয়ারম্যান’কে ‘চেয়ারপার্সন’ করে ছেড়েছেন। কিন্তু হাসপাতালে মেটার্নিটি ওয়ার্ডের পাশাপাশি ‘পেটার্নিটি ওয়ার্ড’ খুলিয়ে দজ্জাল স্বামীর গর্ভসঞ্চারের ব্যবস্থা করতে পারেননি। তেমনি ‘সোনাগাছি’র পাল্লা দেওয়া ‘হীরেগাছি পট্টি’ শহর প্রান্তে খোলাতে পারেননি। কনফার্মড ব্যাচিলার প্রৌঢ় বয়সেও আইন-সম্মতভাবে দেহের ক্ষুধা মিটিয়ে আসতে পারে প্রস-কোয়ার্টার্সে; চার অঙ্কের উপার্জনক্ষমা কুমারী, ডিভোর্সি বা বিধবার কোনো বিকল্প আয়োজন নেই। ক্যালকাটা কর্পোরেশনের ‘চেয়ারম্যান’কে উৎখাত করে কোন জাঁদরেল ‘চেয়ারওম্যান’ গদী দখল করলেও সে সুযোগ মহিলাদের দিতে পারবেন না, এই একদেশদর্শী পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায়।
হয়তো সেই হেতুতেই H.D. 31 পত্রমিতালীর প্রত্যাশী।
কিন্তু 36-24-37!!
নিশ্চয় সংখ্যাতত্ত্বে গোঁজামিল আছে কিছুটা।
০৪. এল চিঠিখানা
০৪.
আট দিনের মাথায় এল চিঠিখানা। কলেজ থেকে ফেরার পথে লেটারবক্সে নজরে পড়ল খামটা। ওঁর নিজের হস্তাক্ষরে লেখা সলিল মিত্রের নামাঙ্কিত লেফাফা। সেটা বার করতে করতে পিছন থেকে রামু জানালো, মামাবাবু এসেছেন। যাদুকর যেভাবে হাতসাফাই করে তেমনি দ্রুতগতিতে চিঠিখানা উনি লুকিয়ে ফেললেন পাঞ্জাবির পাশ-পকেটে। জানতে চাইলেন, মামাবাবু কোথায়? প্রত্যাশিত জবাবই পেলেন : মাজির কামরায়।
জগদীশ প্রণতির চেয়ে বছরতিনেকের ছোট। সপ্তাহে অন্তত একবার অফিসফের্তা গল্পগাছা করে যায়। এখানেই চা-খাবার খেয়ে সন্ধ্যা ঘনালে বাড়ি ফেরে। তখন বাসের ভিড়ও কমে যায়। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে অসীমা আর তোতনকে নিয়ে আসে। সেদিন দুপুরে এখানেই আহারাদি করে। সেই দিনগুলি প্রণতির ভারি আনন্দের। স্তব্ধ বাড়িটা একদিনের জন্য মুখর হয়ে ওঠে। আগে সেসব দিনে চাঁদুর মায়ের মুখখানা ঘঁড়িপানা হত। এখন হয় না। প্রণতি কায়দাটা শিখে ফেলেছে। বলে, চাঁদুর জন্য একটা মাছ, আর একবাটি পায়েস নিয়ে যেও চাঁদুর্মা।
তালুকদার এ ঘরে এসে দেখলেন রামু মামাবাবুকে চা-জলখাবার দিয়ে ইতিপূর্বেই যথারীতি আপ্যায়ন করেছে।
জগদীশ চায়ের কাপটা নামিয়ে একটা সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত।
তালুকদার বললেন, ধূমপানের বিরুদ্ধে এত এত প্রচার, তবুও ঐ বদভ্যাসটা কেন ছাড়তে পার না–বল তো জগু?
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে জগদীশ বললেন, এন-এথবার কথাটা বললে জামাইবাবু, ‘হোয়্যার এন টেন্ডস্ টু ইনফিনিটি’! এ মাইনাস-ওয়ানেথবার তোমাকে বলেছি যে, তোমার এ উপদেশ পৌনঃপুনিকতা দোষে অতিদুষ্ট। তবু তুমি বদভ্যাসটা কেন ছাড়তে পার না বলত? তুমি বরং আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও দিকিন?
–কী?
–সলিল মিত্র ব্যক্তিটি কে?
যেন রিফ্লেক্স অ্যাকশন!
প্রত্যুত্তর ঠোঁটের আগায় : আমার এক প্রাক্তন ছাত্র। কেন?
শুধু তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তিই নয়, ওঁর ‘আই কিউ’ ফেনমেনাল। প্রশ্নমাত্র কম্পুটারের দ্রুততায় বুঝে নিলেন : জগদীশ অহেতুক কৌতূহলে লেটার-বক্সে উঁকি মেরে দেখেছে, বাড়ির ভিতরে আসার আগে। কাঁচের ভিতর দিয়ে নামটা যে পড়া যাচ্ছিল তা অনুমাননির্ভর নয়, স্বচক্ষে দেখা।
বললেন, কেন সলিলকে কী দরকার?
–না, তাই জিজ্ঞেস করছি। লেটার-বক্সে দেখলাম কিনা–অচেনা নাম।
অধ্যাপক তালুকদার অন্যমনস্কতার অভিনয় করে পাঞ্জাবির পাশ-পকেট থেকে লেফাফাখানা বার করে দেখে আবার পকেটেই রাখলেন।
বললেন, বেচারি থাকে ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে। চিঠি ডেলিভারি হতে দেরী হয়। তাই এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লেখাবার পর আমাকে বলেছে…. যাক সে কথা। তোতনরা কেমন আছে?
‘খেজুরে-গল্প’ কিছুটা চালিয়ে গা ধোওয়ার অছিলায় ঢুকে গেলেন বাথরুমে।
কিন্তু এ কী?
খামের গর্ভে রয়েছে তাঁর নিজেরই লেখা চিঠিখানা! অর্থাৎ যে চিঠি লিখেছেন সলিল মিত্র H.D. 31-কে।
তার অর্থ? চিঠিখানা ও ফেরত দিল কেন?
রুদ্ধদ্বার স্নানকক্ষে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েকটা মুহূর্ত। তীক্ষ্ণবুদ্ধির পণ্ডিতটি কোনো কার্যকারণ-সূত্রের সন্ধান পেলেন না। ও যদি যোগাযোগ করতে না চায়–তা তো নাই চাইতে পারে–উনি বিবাহিত, প্রৌঢ়-কিন্তু সেক্ষেত্রে মেয়েটির পক্ষে স্বাভাবিক হত খামটা ছিঁড়ে ফেলা। অথবা বাস্তববুদ্ধি প্রখর হলে সাবধানে ‘সেলফ অ্যাড্রেসড’ খামের অব্যবহৃত ডাক-টিকিটটা জলে ভিজিয়ে খুলে নেবার পর খামটা ছিঁড়ে ফেলা।
হঠাৎ একটা কথা খেয়াল হল। উল্টোপিঠটা দেখলেন। তাই বল। একই কাগজের বিপরীতপ্রান্তে গোটা গোটা মেয়েলি হরফে লেখা :
“কবিবরেষু,
“অহোবত! কী সৌভাগ্য! একে সাহিত্যিক, তায় কবি! তুমি আমার বিজ্ঞপ্তিবসনের খাঁজে খাঁজে এক নম্বর, দু-নম্বর কী অনুমানের খোঁজ করেছ তার আমি কী বুঝব? লেখক হিসাবে তোমার জানা উচিত : এই বিশ্বপ্রপঞ্চের আধখানা কে বানিয়েছে তা আমরা জানি না, কিন্তু বাকি আধখানার সৃষ্টিকর্তা আমরাই—’আপন মনের মাধুরী মিশায়ে…’