যেমন আজ। প্রয়োজন ছিল না। তবু ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজার ছিটকিনিটা বন্ধ করে ড্রয়ারটা টেনে খুললেন। আবার একবার পড়লেন H.D.31-এর বিজ্ঞপ্তি। অস্বীকার করতে পারেন না–দুরন্ত কৌতূহল হচ্ছে ব্যাপারটা জানতে। কী চায় মেয়েটা? ডিভোর্সি। ফলে আশা করা অন্যায় হবে না যে, সে নতুন জীবনসাথী চায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে ঐভাবে কোনো মেয়ে কায়দা করে জানিয়ে দিতে পারে নিজের ‘ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স’? বক্ষ-কটি-নিতম্বের বেড়?
কিন্তু এমনও হতে পরে মেয়েটি ‘আলট্রা-মডার্ন’! সম্ভাব্য জীবনসঙ্গীকে জানাতে চায় যে, একটি স্বামীর সঙ্গে কিছুদিন ঘর করলেও সে তার ফিগারকে হারিয়ে ফেলেনি। তার যৌন-আকর্ষণ অবিকৃত।
অথবা যা উনি আশঙ্কা করছেন : H.D. 31 একটি ‘কলগ্যের্ল’, উচ্চকোটির বারবিলাসিনী। সে-কথা মনে হয়েছে বলেই পত্রিকাখানা সঙ্গে করে এনেছেন, ট্যাক্সিতেই ফেলে আসেননি।
ইচ্ছা, এটা কল্যাণকে পাঠিয়ে দিয়ে তদন্ত করে দেখতে বলবেন।
কিন্তু কল্যাণকে পত্রিকাখানা পাঠিয়ে দেবার আগে একটু যাচাই করে দেখে নেওয়া কি উচিত হবে না? উনি যা অনুমান করছেন, আশঙ্কা করছেন, তা যদি না হয়, ও যদি সত্যিই এক দুঃসাহসিকা পত্রবন্ধুত্বের প্রার্থিনী হয়? শুধু মেয়েটার কাছে নয়, কল্যাণের কাছেও তাহলে অপ্রস্তুতের একশেষ হতে হবে। মুখে বলবে না, কল্যাণ হয়তো মনে মনে বলবে, স্যারের মনের মধ্যেই আছে ‘পাপ’, আর তাই একটি অতি আধুনিকা একান্তচারিণী মহিলার পত্রমিতালীর নিষ্পাপ কামনাকে উনি একটা কুৎসিত চিন্তায় মণ্ডিত করে দেখছেন।
হবে না? ওঁর নিজের যৌনজীবনই যে…..
নাঃ। একটা এসপার-ওসপার করতে হবে!
বন্ড-কাগজের বান্ডিল রাখাই থাকে দেরাজে। উপন্যাস লেখার উপকরণ। তা থেকে একটা শাদা কাগজ টেনে নিয়ে লিখলেন,
‘সুচরিতাসু,
‘পত্রমিতালী’ পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় তোমার বিজ্ঞপ্তিটি পড়লাম। জানি না, ইতিমধ্যে তুমি আর কারও মিত্ৰাণী হয়ে গেছ কি না। অবশ্য তা না হলেও আমার ক্ষেত্রে অসুবিধা আছে–যদি আমার এক নম্বর অনুমানটা ঠিক হয়। প্রধান অসুবিধা এই যে, আমি বিবাহিত। তাছাড়া আমি বয়সে তোমার দ্বিগুণ না হলেও দ্বিগুণের কাছাকাছি। কিন্তু আমার এক নম্বর অনুমানটাই কি নির্ভুল? জীবনসঙ্গী তো চাইছ না তুমি, চাইছ : পত্রমিতালী।
ফুলের যা দিলে হবে নাকো ক্ষতি, অথচ আমার লাভ
আমি চাই সেই সৌরভ শুধু, অতনু-অতল ভাব।
ঘাঁটিতে না চাই দুনিয়ার মাটি
তারই মাঝে মিশে রয়েছে যা খাঁটি
আমি চাই সেই পরশমণির চুম্বিত সোনাটুক,
যাহা দিলে তার কোন ক্ষতি নাই, আমার ভরিবে বুক।
হয়তো আমার এই দ্বিতীয় অনুমানটাই নির্ভুল। সেক্ষেত্রে আমি উৎসাহী। কেন বলি। আমি লেখক। কবি। ঔপন্যাসিক। নামে চিনবে না। কারণ আমি লিখি ছদ্মনামে। তুমি যদি আমাকে একটা নতুন ধরনের উপন্যাসের প্লট দিতে পার তাহলে যথাযোগ্য সম্মানদক্ষিণা দিতে আমি স্বীকৃত।
আমি জানতে চাই : কেন? কেন? কেন?
আমার প্রথম অনুমানটি যদি সঠিক হয়, এবং দ্বিতীয়টি ভ্রান্ত তাহলে জবাব দিও না আদৌ। খামটা ছিঁড়ে ফেল।
ইতি–তোমার কল্যাণকামী
সলিল মিত্র।”
.
ঠিকানা নির্ভুলই দেওয়া থাকল।
ও যদি আদৌ জবাব দেয়, তাহলে তা এসে পৌঁছবে এই দ্বিতল বাড়ির একমাত্র লেটার-বক্সে। তার চাবি ওঁর কাছে থাকে। দু-একবার চিঠি গোলমাল হওয়ার পর ইদানীং লেটার-বক্সের চাবি রামুকে দেন না। ‘সলিল মিত্র, কেয়ার অফ প্রফেসর আর তালুকদার’ লেখার প্রয়োজন নেই। বীট-পিওন ঠিকানা অনুযায়ী ঐ লেটার-বক্সেই চিঠিখানা ফেলে যাবে।
০৩. ঘোরের মধ্যে
০৩.
সাতটা দিন যেন ঘোরের মধ্যে কেটে গেল তারপর। কাজটা কি ঠিক হল? হাতের লেখাটা ওঁর, ঠিকানা ওঁর বাড়ির। কিন্তু এ নিয়ে কেই বা যাচ্ছে তদন্ত করতে? হয়তো H.D. 31 আদৌ জবাব দেবে না। তাঁর এক নম্বর অনুমানটি যদি সত্য হয় অর্থাৎ ডিভোর্সি মেয়েটি যদি নতুন করে জীবনসঙ্গীর সন্ধানে পত্রমিতালীর পথ বেছে নিয়ে থাকে। আশা করছে অসংখ্য চিঠি পাবে। তার ভিতর বেছে নিয়ে চার-পাঁচটি স্যুটারকে জবাব দেবে। যারা চাকুরে, সুদর্শন, প্রায়-চল্লিশ। ডিভোর্সি হলেও ক্ষতি নেই, যদি না আগের আহাম্মকির একটি বোঝা কাঁধে চাপিয়ে থাকে।
অবশ্য ডিভোর্স-কেসে সে ঝামেলা স্ত্রীকেই সচরাচর পোহাতে হয়। কর্তা ‘যথাবিহিত কাঞ্চনমূল্যেই’ সচরাচর প্রায়শ্চিত্তটা করে থাকে।
আচ্ছা, ওর নিজের একটি সন্তান নেই তো? ও তো নিজেই ডিভোর্সি।
তা ছাড়া H.D. মানে কি? ‘হিন্দু ডিভোর্সি? হ্যাঁ তাই। ঐ যে আজন্মকুমারী মেয়েটি বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে যে, সে পার্ট-টাইম টাইপিস্ট, বয়স বত্রিশ, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, পাঁচ ফুট এক ইঞ্চিতার নম্বর H.U. 51–-অর্থাৎ ‘হিন্দু আনম্যারেড।
পত্রমিতালীর সম্পাদকমশাই দেখা যাচ্ছে বিচক্ষণ ব্যক্তি। ‘প্রজাপতি মার্কা’ দপ্তর খোলেননি, কিন্তু মূল কারবারটা ঐ দিকেই ঝুঁকেছে। তাই ক্রমিক সংখ্যাগুলি যে জাতের বিশেষণে বিভূষিত, সেগুলি জাতপাত এবং ‘ম্যারিট্যাল স্ট্যাটাস’-এর দ্যোতক।
যাক সে কথা, যে কথা ভাবছিলেন। ঐ H.D. 31-এর কথা। দু চারটি পত্রবিনিময়ের পরেই মেয়েটা জানতে পারবে–কে কেরানি, কে গেজেটেড অফিসার। কার বুড়ি-মা ব্যাটার-বৌয়ের সেবার প্রত্যাশায় বেতো ঠ্যাঙ নিয়ে প্রতীক্ষা করছে এবং কার নির্ঞ্ঝাটের সংসার। পত্রালাপের অবকাশে জেনে নেওয়া যাবে কী কী হবি, পড়াশুনা কতদূর, গাড়ি-বাড়ি আছে কি না। নিদেন নিজস্ব ফ্ল্যাট। তারপর কায়দা করে জেনে নিতে হবে : প্রথমপক্ষের স্ত্রীর মৃত্যুর হেতুটা কী? সে কি বাথরুমে গায়ে (???)