ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে প্রথমেই গেলেন ছট্টুলালের রিপেয়ার-শপে। ওঁর দ্বিতল ভদ্রাসনের বিপরীতে। রিপেয়ার-শপে ছট্টুলাল চাবির গোছ হস্তান্তরিত করে বললে, গাড়ি আপকা গ্যারেজমে ঘুস্ দিয়া।
মানিব্যাগটা বার করতে করতে প্রশ্ন করেন, কী গড়বড় হয়েছিল?
–কুছ নেহি, প্রফেসার সাব। কার্বুরেটারমে থোড়া….নেহি, নেহি, কুছু নেহি দেনা হ্যয়….
ছট্টুলালের বড় ছেলেটি ওঁরই সুপারিশে ওঁর এক ছাত্রের অফিসে কর্মসংস্থান করেছে। ‘কুছু লিখাপড়ি’ শিখেছে কিনা, তাই গ্যারেজে কালিঝুলি মাখতে রাজি নয়। প্রফেসার-সাবের দয়ায় সে নোকরি জুটিয়ে নিয়েছে। তাই ছোটখাটো মেরামতির জন্যে প্রফেসার-সাহেবের কাছে ছট্টুলাল হাত পাততে নারাজ।
উনি একটা বিশ টাকার নোট ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, নাও, ধর। এটা তোমার মজুরি নয়। শিউশরণকে মিঠাই খেতে দিচ্ছি আমি।
শিউ হচ্ছে ছট্টুলালের নাবালক বাচ্চাটা।
ছট্টুলাল হাত বাড়িয়ে নোটখানা গ্রহণ করে। কপালে ঠেকায়। মুখে বলে, ঈ-কোথা বোল্নেসে ম্যয় তো নাচার!
ডক্টর রঞ্জন তালুকদার এ-পাড়ায় দীর্ঘদিন আছেন। সবাই চেনে। শ্রদ্ধা করে। পণ্ডিত মানুষ হিসাবে! লেখক হিসাবে। চিররুগ্ন পত্নীর একনিষ্ঠ সচ্চরিত্র স্বামী হিসাবে। রাস্তাটা পার হয়ে উনি নিজের বাড়ির কল-বেল বাজালেন। ভিতর থেকে ভিয়ু-ফাইভারে সতর্ক দৃষ্টিক্ষেপ করে দেখে নিয়ে দরজা খুলে দিল রামু, ওঁর কম্বাইন্ড হ্যাণ্ড। বছর তের-চৌদ্দ। চটপটে। ছটফটে।
–মাকে কমপ্ল্যান বানিয়ে দিয়েছিলি?
–জী হাঁ।–হাত বাড়িয়ে ফোলিও ব্যাগটা নিতে যায়।
অভ্যাসবশে ব্যাগটা হস্তান্তরিত করতে গিয়ে হঠাৎ থমকে থেমে যান। পত্রিকাখানা ট্যাক্সিতে ফেলে আসেননি। ফোলিও-ব্যাগটা চাবিবন্ধ করা নেই। রামুর অবশ্য অক্ষর পরিচয় নেই; কিন্তু প্রায়-বিবস্ত্রা একটি রমণীর দেহসৌন্দর্য পাঠের জন্য অক্ষর-পরিচয় আবশ্যিক নয়।
বলেন, না রে। খাতা আছে।
রামু জানে, ব্যাগে খাতা থাকলে সেটা ছুঁতে নেই। ‘খাতা’ মানে কোন ছাত্রের রিসার্চ-পেপার। অথবা পরীক্ষার খাতা। সে সময় রামুর ব্যাগ ছোঁয়া মানা। সাহেব নিজে হাতে ঐ ‘খাতা’ সর্বাগ্রে তাঁর ড্রয়ারে বা আলমারিতে ভরে অন্য কাজে মন দেবেন। ব্যাগটা নিয়ে উনি বৈঠকখানায় ঢুকলেন। এটা ওঁর স্টাডিরুমও বটে। আলমারিতে সচরাচর রাখেন রিসার্চ-পেপার। আজ কিন্তু উনি আলমারি খুললেন। স্টিল-টেবিলের টানা-ড্রয়ারে পত্রিকাখানা ঢুকিয়ে চাবি দিলেন। প্রয়োজন ছিল। রামু কখনো ওঁর ড্রয়ার খোলার চেষ্টা করবে না। আর প্রণতি তো উত্থানশক্তি রহিতা। তবু সাবধানের মার নেই।
কলেজের জুতো-জামা খুলে শয়নকক্ষে আসতেই প্রণতি বলেন, ট্যাক্সি করে ফিরলে যে? গাড়ির কী হল?
–গণ্ডগোল করছিল। ছট্টু মেরামত করে দিয়েছে।
কথা বলতে বলতে বিছানার পিছন দিকে চলে যান। দৃষ্টির আড়ালে সেখানে টুলের উপর রাখা আছে ইউরিনাল পটটা। ওটা তুলে নিয়ে বাথরুমের দিকে চলে যান। নিত্যকর্মপদ্ধতি। অতি দীর্ঘ দিন। প্রণতি কতবার বলেছেন এ জন্য জমাদারকেই কিছু বাড়তি দিয়ে বন্দোবস্ত করে নিতে। গৃহকর্তা সম্মত হননি। শয়নকক্ষে তিনি জমাদারকে ঢুকতে দেবেন না, কিছুতেই না। জাতপাতের কুসংস্কারে নয়, তিনি বিশ্বাস করেন নিজের ‘ক্রুশ’ যতটা সম্ভব নিজেকেই বইতে হয়। বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থায় সেটা হয়তো শতকরা শতভাগ সম্ভবপর নয়। তাই ঐ ‘যতটা সম্ভব’। জমাদারদেরই বা কেন জানাবেন যে, ওঁর জীবনসঙ্গিনী উত্থানশক্তি-রহিতা। সেটা ওঁর দাম্পত্যজীবনের অন্তরালের কাহিনী।
ফিরে এসে টুলের উপর পাত্রটা রেখে বসে পড়েন ইজিচেয়ারে। বলেন, বইটা শেষ হয়েছে? লাইব্রেরির বইটা?
–না! কিন্তু এ অসময়ে পরীক্ষার খাতা নিয়ে এলে কোথা থেকে? না কি কারও রিসার্চ-পেপার?
উফ! আর তো পারা যায় না।
রামুটি একটি বিচ্ছু। প্রণতির ইনফর্মার! পান থেকে চুনটুকু খসবার উপায় নেই। মায়ের কানে কানে বলে আসবে। না হলে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে প্রণতির জানার কথা নয় যে, উনি ট্যাক্সি করে ফিরেছেন। অথবা ওঁর ব্যাগে আজ ‘খাতা’ আছে। তবে এ নিয়ে মনে ক্ষোভ রাখা অন্যায়। কী সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে প্রণতির পৃথিবী! এটুকু কৌতূহলও যদি বজায় না থাকে তাহলে ও বাঁচবে কী কী নিয়ে?
–কী হল, বললে না? পরীক্ষার খাতা, না রিসার্চ পেপার?
গলার স্বরটা নামিয়ে স্রেফ মিথ্যা কথাই বললেন, আরে না! খাতা-ফাতা কিছু নয়। ক্যাশ টাকা আছে। কলেজ ফান্ডের। সে আমি ভুলে রেখে এসেছি।
না, এটা মিথ্যা নয়, মনু বলেছেন, শত্রু ও ধর্মপত্নীর কাছে মিথ্যা বলায় পাপ হয়না–সে জন্যও নয়। এটা ‘সত্য’ এ-কারণে যে, এ ‘শিব’ ও ‘সুন্দরের’ অনুষঙ্গ।
রামু ইতিমধ্যে খাবারের প্লেট নিয়ে ঢোকে।
বৈকালিক ভোগই হবার কথা, তবে আজ সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। রামু দু-কাপ চাও নামিয়ে রাখে। প্রণতি বিকালে চায়ের সঙ্গে আর কিছু খান না। সহ্য হয় না। আর অধ্যাপক মশাই শুধু বৈকালিক আহারটুকুই নয়, প্রত্যহ লাঞ্চ এবং ডিনার সারেন এ ঘরে। স্ত্রীর সান্নিধ্যে।
সেও আজ কয়েক দশক।
টি. ভি. প্রোগ্রাম শুরু হল। প্রণতির মুখস্থ। কোন বারে কী সিরিয়াল। এই সান্ধ্য অবকাশটুকু যাপনের মধ্যে তবু ‘কিছুটা’ বৈচিত্র্য আছে। লোডশেডিং হলেও অসুবিধা নেই। বিজ্ঞানের অধ্যাপক মশাই ইনভার্টার বসিয়ে দিয়েছেন। যেদিন টি. ভি.-তে ‘অখাদ্য’ প্রোগ্রাম হয়–আর বাঙলা সিরিয়াল তো অধিকাংশই তাই–সেদিন শুরু হয় ভি. ডি. ও. সিনেমা। রামু আর চাঁদুর মা দুজনেই তা চালাতে জানে। রামু অথবা চাঁদু পাড়ার ভি. ডি. ও. পার্লার থেকে লিস্ট মিলিয়ে ক্যাসেট নিয়ে আসে, ফেরত দেয়। হিন্দিই বেশি। ডক্টর তালুকদারের কাছে এসব আউট অব বাউন্ডস। ‘ওয়ার্ল্ড দি উইক’ অথবা ভাল ইংরেজি সিরিয়াল না হলে তিনি তখন নেমে যান স্টাডিরুমে।