পাকা ব্যবস্থা। সম্পাদক যথাযথ ব্যবস্থা করবেন। অবাঞ্ছিত সমাজবিরোধী মানুষ যাতে পত্রমিতালী-প্রার্থীকে বিড়ম্বিত, বরং বলা উচিত বিড়ম্বিতা করতে না পারে তাই এত সাবধানতা। তবে হ্যাঁ, ‘পত্রমিতালী’ প্রতিষ্ঠার পর সম্পাদকের আর কোনো দায়দায়িত্ব থাকবে না– এ বিজ্ঞপ্তিও স্পষ্ট ভাষায় ঘোষিত।
সূচীপত্রে পরিচিত নাম একটাও খুঁজে পেলেন না। একটি ছোট গল্প, কবিতা গুটি তিনেক–নিতান্ত মামুলী। প্রবন্ধ একটি, পতিতাবৃত্তির উপর। সচিত্ৰ, সোনাগাছি, হাড়কাটা গলির। মামুলী। একটু যৌনতা ঘেঁষা। অশ্লীল নয় তা বলে।
প্রফেসর-সাহেব মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিলেন–যোধপুর পার্ক দূর অস্ত্। সর্দারজি স্টিয়ারিং হুইলে নিমগ্ন। কলকাতার রাস্তার ধারে সারি সারি বাড়ি পিছনে ছুটছে। উনি পত্রমিতালীর তালিকা ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন। সাহিত্যসেবী হলেও বিজ্ঞানীর মন। উনি মনে মনে পত্রবন্ধুত্বকামেচ্ছুদের বেশ কয়েকটি বিভাগে শ্রেণীবদ্ধ করে ফেলতে পারলেন। প্রথম দল অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে। তারা প্রায়শই ছাত্রছাত্রী। যৌবনের সিংহদ্বারে সদ্য উপনীত। ওঁর বাল্যকালে ছেলে-মেয়েদের পৃথক স্কুলে পড়তে হত। মাত্র কয়েকটি কলেজে ছিল কো-এডুকেশন। একই ক্লাসের ছেলে মেয়েরা বিপরীত লিঙ্গের ক্ষেত্রে ‘আপনি’ বলে কথা বলত। ওঁর নিজের কৈশোরে, যে বয়সে উনি একটা অজানা জগতের ইশারা পেয়ে চঞ্চল হতেন, আজকালকার দিনে সেটা ওদের কাছে আর ‘অজানা’ নয়। ওঁদের ছাত্রকালে যে-তথ্যটা পাঠ্যসূচি থেকে সযত্নে পরিহার করা হত, সেই জীবনসত্যটা আজকে জীববিজ্ঞানের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। হয়তো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, এই যা। এরা সকলেই বন্ধু বা বান্ধবীর সন্ধান করছে। স্পষ্ট বলা নেই, কিন্তু লক্ষ্য:ভিন্ন লিঙ্গের পত্রবন্ধুত্ব। ওরা বিপরীত প্রান্ত থেকে একটু সমমর্মিতা চায়। একটু সহানুভূতি, সান্ত্বনা, পরস্পরের কাছ থেকে উৎসাহ আশার বাণী শুনতে চায়। কেউ জানিয়েছে তার সঙ্গীতে আসক্তি, কেউ ক্রিকেটে, কেউ বা টি. ভি. সিরিয়ালে। দু একজন জানিয়েছে টি, ভি, সিনেমা, নিতান্ত না হলে গ্রুপ-থিয়েটারে নামতে চায়, অথচ বাড়িতে আপত্তি। এ নিয়ে অশান্তি। এই হচ্ছে প্রথম গ্রুপ।
দ্বিতীয় একটি গ্রুপের আভাস পেলেন যারা ‘নাল্পেসুখমস্তি’ মন্ত্রে বিশ্বাসী। দেখাই যাক না, ঘটনা কতদূর গড়ায়’–ভাবখানা ওদের। এরা বিবাহিত কিনা বোঝা যায় না, কিন্তু বৈচিত্র্যসন্ধানী। এক্ষেত্রে xx সন্ধান করছে XY-এর। এবং কনভার্সলি। অর্থাৎ ক্রমোজমের হিসাবে।
তৃতীয় একটি গোষ্ঠী–তারা উত্তর-চল্লিশ–যেন গুনগুন করে গাইছে : ‘ঘরের কোণে ভরা পাত্র, দুই বেলা তা পাই/ঝরনাতলার উছলপাত্র নাই।’
এরা যৌবনের হারিয়ে যাওয়া রোমাঞ্চটিকে ফিরে পাওয়া যায় কিনা তাই পরখ করে দেখতে চায়–ঘরণী বা গৃহস্বামীর দৃষ্টির আড়ালে।
এ-ছাড়া আরও একটি গ্রুপে আছেন কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। পড়ন্ত বিকালের বৈঠকের সভ্য-সভ্যা। এঁরা অবসরপ্রাপ্ত। সংসারে তাদের আকর্ষণ কম, বন্ধন ক্ষীয়মাণ। সময় কাটতে চায় না। সবারই বাড়িতে কিছু টি, ভি, বা ভি. সি. পি. থাকে না। সঙ্গী একমাত্র লাইব্রেরি। তাও যাদের চোখের দৃষ্টি অক্ষুণ্ণ। ছেলেমেয়ে, ছেলের বউ, জামাই, নাতি-নাতনি হয়তো ভগবান অকৃপণ হাতেই দিয়েছেন, কিন্তু তাদের কাছে ওঁরা বোঝা মাত্র। তাদের আলোচনার মাঝখানে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হলে তারা সংযত হয়ে পড়ে, আড়ষ্ট হয়ে পড়ে-ভাবখানা, যেন মনে মনে বলে –এই এলেন সর্বঘটের কাঁঠালিকলা।’ প্রকাশ্যে : ‘ও ঠাম্মা! তুমি আবার এখানে উঠে এলে কেন?’
দিনযাপনের গ্লানি কাটাতে তাঁরা কিছু সমমর্মী মানুষ খুঁজছেন। পত্রমিতালীর মাধ্যমে।
এই তিন-চার শ্রেণীর নরনারীর ভিড়ে গুটিকতক চিঠি নিতান্ত বিভ্রান্তিকর। বলা যায় ‘অড-উয়োম্যান আউট’। বিজাতীয়া। এমন পাঁচখানা চিঠি অন্তত নজরে পড়ল ওঁর, ঐ অল্প সময়ে।
এরা কী? এরা কে? এরা কী চায়?
পাঁচটি চিঠিই এক বিশেষ এজ-গ্রুপের : পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ। অব্যক্রিম মহিলা। নিজ নিজ স্বীকৃতি-মোতাবেক পাঁচজনেই চাকুরে, একান্তচারিণী। দুইজন ডিভোর্সি, দুজন বিধবা, একটি আজন্মকুমারী।
কেন এরা ব্যতিক্রম? শোন, বুঝিয়ে বলি, লক্ষ্য করে দেখবয়স, শিক্ষাগত মান, হবির তালিকা জানিয়েই এরা থামেনি, জানিয়েছে উচ্চতা, গাত্রবর্ণ, সৌন্দর্যের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত এবং ওজন। পত্রমিতালীর পক্ষে এ-জাতীয় সংবাদ কি প্রাসঙ্গিক? সবচেয়ে বিস্ময়কর : একটি ডিভোর্সি মেয়ে জানিয়েছে তার উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন, বয়স ত্রিশ, সে চাকরিরতা এবং তার হবি : ‘স্ট্যাটিসটিক্স’।
অপিচ, তার নিজস্ব ‘ভাইটাল’ : 36-24-37।
ট্যাক্সিটা ফ্লাইওভারের উপর উঠছে। বাঁয়ে : অবনমহল। ওঁর বাড়ি আর মিনিট পাঁচ-সাত। হঠাৎ কল্যাণের কথা মনে পড়ে গেল ওঁর। কল্যাণ সেনগুপ্ত। ওঁর ছাত্র। দিল্লীতে পোস্টেড। আই. পি. এস.। পুলিসের এক বড়কর্তা। পত্রিকাটা কল্যাণকে পাঠিয়ে দিতে হবে। এটা তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতার আবশ্যিক অঙ্গ। প্রতিটি মানুষের কর্তব্য এ জাতীয় অনাচার বন্ধ করা। এ তো নলচের আড়াল দিয়ে পতিতাবৃত্তির বিজ্ঞপ্তি। কল্যাণ যা ভাল বোঝে করবে।
০২. ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে
০২.