–বলছি। কোনো একজন ‘এ-ওয়ান’ ধুরন্ধর ওস্তাদের শেষরাত্রের প্যাঁচে। তিনি ঐ মস্তানের দাবী মেনে নেন। ব্ল্যাকমেলিঙের টাকাটা মিটিয়ে দেন একটা মজবুত কালো রঙের স্টীলের ক্যাশবাক্সে। ওরা গুরু-শিষ্য কেউ কাউকে বিশ্বাস করত না। দুজনেরই আশঙ্কা ছিল যে, পার্টনার-ইন-ক্রাইম ডবল-ক্রশ করবে। তাই ক্যাশবাক্সটা খোলার সময় দুজনেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল দশ বিশ টাকার নোটের বান্ডিল গুনতি করতে। চাবিটা সেলোটেপ দিয়ে বাক্সের গায়েই আটকানো ছিল। চাবি লাগিয়ে পাল্লাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণ হয়। টালিঘরের আধখানা ছাদ উড়ে যায়। গুরু আর চেলার দেহ শতচ্ছিন্ন। কোনটা কার হাত, আর কোনটা কার পা, তা জিগ্স পাজল-এর মতো পুলিসকে মেলাতে হয়েছে। শিষ্যকে সনাক্ত করা গিয়েছে তার একটি টিপিক্যাল টম্যাটো রঙের স্পোর্টস্ গেঞ্জি দেখে, আর গুরুর মাথায় হেলমেট পরা ছিল বলে তার মুণ্ডুটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়নি। দুজনের নামেই একাধিক পুলিস কেস ছিল। সনাক্ত করার কোনও অসুবিধা হয়নি।
মরা পাবদা মাছের মতো নিষ্পলক দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন অধ্যাপক তালুকদার। মুখটা হাঁ।
ডিটেকটিভ-সার্জেন্ট বুঝিয়ে বলে, আসলে বাক্সটা ছিল একটা বুবি-ট্র্যাপ। ইঁদুর মারা কলের স্প্রিং-এর স্টোর-করা স্ট্যাটিক এনার্জি পাল্লা খোলার সঙ্গে সঙ্গে কাইন্যাটিক এনার্জিতে রূপান্তরিত হয়ে ড্রাই সেল ব্যাটারির ফিউজ দুটিকে জুড়ে দেয়। ইলেকট্রিক স্পার্ক দেয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ।
তালুকদার জিব দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে বলেন, য়ু মীন বোমা? বোমা বিস্ফোরণ? ক্যাশবাক্সে বোমা এল কোথা থেকে?
প্রণব হাসতে হাসতে বললে, বোমা-পেটো আজকাল রাম-শ্যাম-যদুও বানায়, স্যার। পাড়ায় পাড়ায়–
–তা বটে!
–কিন্তু এটা কোন রাম-শ্যাম-যদুর হাতের কাজ নয়।
তালুকদার ইতস্তত করে বললেন, এ কথা কেন বলছ?
–কারণ এটাতে ছিল ‘মাস্টার টাচ’! কে বানিয়েছেন তা নিয়ে আপনি কোন চিন্তা করবেন না, স্যার! তিনি ধরণীর পাপের ভার কিছুটা লাঘব করেছেন। তিনি আমাদের নমস্য…..
তালুকদার ক্ষীণ প্রতিবাদ না করে পারেন না, না, না, তা বললে কি চলে? সবাই যদি এভাবে আইন নিজের হাতে নেয়….
প্রণব হেলমেটটা বগলদাবা করে উঠে দাঁড়িয়েছিল। এ-কথায় একগাল হেসে বলে, না, স্যার! সবাই তা পারে না। এক্সপ্লোসিভে বিশেষ ট্রেনিং নিয়েছি বলেই আমাকে এই তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে। একোয়ারি করে আমি যা বুঝেছি তা আমি আমার রিপোর্টে লিখতে পারব না। তবে আপনি পণ্ডিত মানুষ, আপনাকে চুপি চুপি জানিয়ে যেতে পারি–আপনি বুঝবেন!
তালুকদার কোনও কৌতূহল দেখালেন না। তা সত্ত্বেও প্রণব একই নিশ্বাসে বলে গেল, আমি নিশ্চিত, ঐ বুবি-ট্রাপটা যিনি বানিয়েছেন তিনি কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, এবং উদ্ভাবনী প্রতিভায় অদ্বিতীয়! হি ইজ আ জিনিয়াস।
তালুকদারের কণ্ঠনালী শুকিয়ে ওঠে।
প্রণব বলে চলে, তবে আপনার ও কথাটাও খাঁটি! হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট। আইন কেউ নিজে হাতে নিতে পারে না। আমরা তা অ্যালাও করতে পারি না। আপনিও বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন, স্যার, আমরা শেষ পর্যন্ত তদন্ত করে দেখব। এক-এক করে ঐ একুশ জনকেই….
–একুশ?
–নয়? আজ আপনার বারে বারে এমন ভুল হচ্ছে কেন, স্যার? এখন তো একুশই বাকি থাকল। আপনি তো ব্ল্যাকমেলিঙের শিকার হননি আদৌ। ফটোগুলোর অস্তিত্বই জানতেন না। দেয়ারফোর বাইশ মাইনাস এক, ইজুক্যালটু একুশ। আচ্ছা চলি, স্যার। তবে যাওয়ার আগে আপনার পায়ের ধুলো একটু নিয়ে যাব।
অধ্যাপক তালুকদার অনুমতি দিতে পারলেন না।
আপত্তি করতেও পারলেন না।
প্রস্তর মূর্তির মতো শুধু দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রণব নিচু হয়ে ওঁর পদধূলি নিল। হেলমেটটা মাথায় চড়ালো। তারপর নির্গমন দ্বারের দিকে একপা এগিয়ে আবার হঠাৎ থমকে থেমে পড়ে।
আবার পিছন ফেরে।
অধ্যাপক তালুকদার অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি বুঝতে পেরেছেন, ঐ প্রণব মজুমদার কোন ‘এনডেঞ্জার্ড স্পেসিস্’-এর দুর্লভ একটি উদাহরণ। ঐ যে মুষ্টিমেয় কিছু পুলিস অফিসার আজও টিকে আছে, যাদের জন্যে এই সর্বব্যাপী দুর্নীতির মধ্যেও মানুষ বেঁচে আছে, শান্তি-শৃঙ্খলার কিছুটা আজও বজায় আছে। পার্টি-ইন-পাওয়ারের প্রতিবন্ধকতার প্রভাবে গুণ্ডা-মস্তান দমন করতে পারে না বলে যারা নিজের নিজের হাত কামড়ায়। প্রণব সেই ‘দুর্লভ-প্রাণী’র একটি দৃষ্টান্ত!
প্রণব বলে, একটা কথা বলতে ভুলেই যাচ্ছিলাম। আপনি আমার একটা উপকার করবেন, স্যার?
অধ্যাপক তালুকদার দুরু দুরু বুকে বলেন, বলো?
–আমি চলে গেলে ডক্টর সেনের বাড়িতে একটা টেলিফোন করবেন, স্যার! ডঃ অপরেশ সেন। তাঁর মেয়ে আজ নিয়ে পাঁচ দিন অনশনে আছে। কেউ তাকে কিছু মুখে দেওয়াতে পারেনি…
–শুনেছি! কিন্তু আমার কথাই বা সে শুনবে কেন?
–শুনবে! কারণ আপনি যে তাকে ঐ সঙ্গে আরও একটা খবর জানিয়ে দেবেন : শ্ৰীযুক্ত লালমোহন বিশ্বাস মশাই দেহ রেখেছেন।
তালুকদার-সাহেব চমকে ওঠেন, কী বললে! লালমোহন বিশ্বাস?
–আজ্ঞে না। তা তো বলিনি আমি–
–তবে কার কথা বলছ? কে মারা গেছেন?
–শ্রীযুক্ত লালমোহন বিশ্বাস ‘মশাই’! পার্টির সম্মানিত কর্মী ছিলেন তো!