–ঐ মস্তান পার্টি সেখানে আবার গিয়ে…
–না, স্যার! মেয়েটির দুঃস্বপ্নের অবসান হয়েছে। তার সাহায্যে আর ব্ল্যাকমেলিং করা যাবে না। ওর অবৈধ সন্তানটি ঐ অ্যানেজেই থাকবে, মাও ওখানে চাকরি করবে….
তালুকদার অফুটে বললেন, থ্যাঙ্ক গড!
ঈশ্বর আছেন কিনা এ প্রশ্নটা কিন্তু এই মুহূর্তে মনে পড়ল না বিজ্ঞানভিক্ষুর।
আবার কিছুটা নীরবতা। অধ্যাপক তালুকদারই সে নীরবতা ভেঙে বললেন, বিশ্বাস কর প্রণব, কাজটা যে বে-আইনী তা আমি আদৌ জানতাম না।
প্রণব চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বললে, আপনাকে একটা কথা পরিষ্কার করে বলা দরকার। আপনি কোনও বে-আইনি কাজ করেননি। ‘প্রস্টিট্যুশান’ এ দেশে ‘ওপেন প্রফেশন’। তাছাড়া আপনি বলছেন, ওকে কোনো টাকাও দেননি। মেয়েটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে যখন নয়, আর সে যখন প্রাপ্তবয়স্ক ….. এমনকি ঐ ফ্ল্যাটে আপনি অনধিকার প্রবেশও করেননি। মেয়েটির আহ্বানে তারই ফ্ল্যাট মনে করে…
–তাহলে তুমি কী অনুসন্ধান করতে এসেছ আমার কাছে?
–আপনার ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তার বিষয়ে আমাদের, মানে পুলিসের, কোনো কৌতূহলই নেই। কোনো জিজ্ঞাস্যও নেই। আমার বড়কর্তার ধারণা ওরা বাই দ্য ওয়ে, ওরা ছিল দুজন, গুরু আর চেলা–ওরা ঐ মেয়েটির সাহায্যে অর্থবান, বয়স্ক ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষদের ঐ অ্যাপার্টমেন্টে টোপ ফেলে টেনে নিয়ে যেত। তারপর বিশেষ মুহূর্তে পর্দার আড়াল থেকে ফটো তোলা হত। এইভাবে এ পর্যন্ত বাইশজন মানুষকে ওরা কবজা করেছে। তারপর ঐ ফটো দেখিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেলিং শুরু হয়ে যেত। এটাই ছিল ঐ গুরু-শিষ্যের ব্যবসা।
গুরু-শিষ্য! নেপো আর মাস্তান। কে গুরু? কে চেলা? তালুকদারের মনে যে এই সব প্রশ্ন জাগছে তা তার মুখ দেখে আদৌ বোঝা গেল না।
তিনি নির্বাক তাকিয়ে রইলেন প্রণবের মুখের দিকে।
–এইবার বলুন স্যার, কী করে মেয়েটির সন্ধান পেলেন?
উনি সংক্ষেপে জানালেন তা। ট্যাক্সির গর্ভে পত্রিকা পাওয়া থেকে টেলিফোনে যোগাযোগ। ট্যাক্সি নিয়ে ‘মেঘচুম্বিত’ অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়া। তারপর অভিজ্ঞতাটা একেবারে সংক্ষেপিত করে বললেন, হঠাৎ দরজায় কলবেল বেজে ওঠায় উনি তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলেন, মেয়েটিকে কোনো টাকাকড়ি না দিয়েই।
–তারপর? টেলিফোন কলটা কখন পেলেন?
–না। তারপর মেয়েটি তো আমাকে টেলিফোন করেনি।
–মেয়েটি নয়। আমি মস্তান অ্যান্ড পার্টির কথা বলছি।
–আহ মাস্তান। হ্যাঁ, মাস্তান বলে একজন আমার শালাকে ফোন করেছিল। প্রিন্সিপাল-সাহেবকেও ফোন করেছিল। কিন্তু আমাকে তো করেনি।
–তার মানে আপনার কাছে কেউ কোনো টাকা দাবী করেনি? ঐ ফটো আর নেগেটিভ ফেরত দেবার প্রস্তাব করে?
–না! ফটো যে তোলা হয়েছে, তাই তো জানতাম না আমি।
–আই সী! আমার মনে হয় আপনার দান আসেনি বলেই। বাইশ জন মানুষকে দোহন করছিল তো ওরা? একে একে অগ্রসর হচ্ছিল। আপনার শ্যালক ও প্রিন্সিপ্যালকে বাজিয়ে রেখেছিল। আশা করেছিল, তাঁরা আপনাকে কিছু বলবেন। আপনি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকবেন। সে যাই হোক, আপনি বলছেন যে, আপনার কাছে ব্ল্যাকমেলের প্রস্তাব নিয়ে কেউ আসেনি। তাই তো?
–না, আসেনি। বোধহয় আমার দান আসার আগেই তোমরা ট্যাংরার বস্তিতে রেড করেছ। … একটা কথা, ঐ ছবিগুলোর কী হবে?
–আমি যে মুহূর্তে লালবাজারে রিপোর্ট করব যে, আপনার সঙ্গে এই ব্যাপারে কোনো যোগাযোগ নেই, তখনই ওরা আপনার খামটা পুড়িয়ে ফেলবে। মাননীয় নাগরিকদের বেইজ্জত করার কোনো বাসনা আরক্ষা-বিভাগের নেই।
–কিন্তু তোমরা যখন তদন্ত করে বেড়াচ্ছ, তখন ব্ল্যাকমেলারকে একদিন না একদিন আদালতে তুলবেই। সেদিন কোনো-না-কোনো মাননীয় নাগরিক তো বেইজ্জতের চূড়ান্ত হবেন।
প্রণবের চা-জলখাবার শেষ হয়েছিল। এখন তার একটু ধূমপানের নেশা চেগেছে। বৃদ্ধ অধ্যাপকের সম্মুখে সে সিগারেটটা ধরাতে চায় না। উঠে দাঁড়ায়। বলে, না, স্যার। ঘটনাচক্রে কোনো মাননীয় নাগরিকই এই বিশেষ ক্ষেত্রে বেইজ্জত হবেন না। আমরা কোনো আদালতে এভিডেন্স হিসাবে ঐ বাইশজনের কোনো ফটোগ্রাফই দাখিল করব না।
–তাহলে ঐ ব্ল্যাকমেলারদের কনভিকশন হবে না? শাস্তি হবে না?
একগাল হেসে প্রণব মজুমদার বললে, ওর কনভিকশন হয়ে গেছে, স্যার। ওর একার নয়, দুজনেরই।–গুরু আর চ্যালার। ডেথ পেনালটি।
তালুকদার অবাক হয়ে বললেন, ডেথ পেনাল্টি! হাইকোর্টে?
–না স্যার। হায়ার কোর্টে!-–উপরের ঘূর্ণমান সিলিং ফ্যানটার দিকে আঙুল তুলে দেখায়।
প্রফেসর সেদিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন। বোঁ-বোঁ করে ফ্যানটা ঘুরছে।
বললেন, তার মানে?
–তার মানে, আমি এখানে কোন ব্ল্যাকমেলিং-এর চার্জের জন্য এনকোয়ারি করতে আসিনি, স্যার। চার্জটা ব্ল্যাকমেলিং নয়।
–তাহলে?
–মার্ডার! খুন!
প্রফেসার তালুকদার এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধবিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর যেন কণ্ঠস্বর ফিরে পান। বলেন, মার্ডার! তার মানে ঐ অ্যান্টিসোশাল গুন্ডা দুটো কাউকে খুন করেছে?
–আজ্ঞে না। ঐ গুরু-শিষ্য দুজনেই খুন হয়ে গেছে।
–গুড হেভেন্স। কী ভাবে? গুলিতে? রিভলভারের?
–এবারেও আপনার অনুমানে ভুল হল, স্যার! এত ভুল তো সচরাচর আপনি করেন না, স্যার?
প্রফেসর তালুকদার গম্ভীর হয়ে যান। সামলে নিয়ে বলেন, তবে কীভাবে?