–আজ্ঞে, না না, আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন! আমরা কিছু তথ্য সংগ্রহ করছি মাত্র। আপনাকে অভিযুক্ত করার ইচ্ছা আমাদের আদৌ নেই। আচ্ছা …. আমি বরং ব্যাকগ্রাউন্ডটা আপনাকে খুলে বলি। তাহলে আপনার পক্ষে আমাদের সহযোগিতা করা সহজতর হবে। শুনুন…. গতকাল রাত্রে ট্যাংরার একটা বস্তির ঘরে সার্চ করতে গিয়ে আমার সহযোগী পুলিস একটা চাবি-দেওয়া অ্যাটাচি-কেস পায়। সেটা খুলে দেখা যায় তার ভিতর গোনা-গুনতি বাইশটা ম্যানিলা-কাগজের খাম। প্রতিটি খামের উপর এক-একজনের নাম লেখা। নাম আর ঠিকানা, কী কাজ করেন, কর্মস্থলের ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর। নামগুলি, অব্যতিক্রম, পুরুষের। আমরা অনুসন্ধান। করে দেখেছি, অধিকাংশই বয়স্ক, অর্থবান এবং জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত পুরুষের। প্রতিটি খামের ভিতর চার-ছয়টি রঙিন হট-শট ফটোগ্রাফ পোস্টকার্ড সাইজ–এবং সেলোফোনে মোড়া ঐ ছয়টি আলোকচিত্রের নেগেটিভ।
মজুমদার এই পর্যন্ত বলে থামল।
অধ্যাপক তালুকদার অধোবদনে নির্বাক বসে রইলেন।
আবার শুরু করল প্রণব, ছবিগুলি সম্পূর্ণ বিবস্ত্র নরনারীর। ইন ফ্যাক্ট, সঙ্গমরত নরনারীর। বাইশটি খামে একই রমণী–কিন্তু পুরুষগুলি বিভিন্ন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, খামের উপর যার নাম-ঠিকানা লেখা আছে তারই ছবি। ….ওর একটা খাম, তাতে ছয়টা ফটো আর ছয়টা নেগেটিভ ছিল….
নিতান্ত সৌভাগ্যই বলতে হবে, এই নাটকীয় মুহূর্তে রামু রুদ্ধদ্বারে টোকা দিল। তালুকদার উঠে পড়েন, এক্সকিউজ মি…
তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দেন।
রামু দুই প্লেট খাবারের ট্রে ও দু’কাপ চা নামিয়ে দিয়ে যায়।
তালুকদার দরজাটা পুনরায় ভিতর থেকে অর্গলবদ্ধ করে ফিরে এসে বসে পড়েন। বলেন, অপ্রিয় আলোচনাটা বরং খেয়ে নিয়ে হবে।
প্রণব চায়ের কাপটা টেনে নেয়। অনেকে খাবার খেয়ে চা পান করে, অনেকে চা-পানান্তে আহারে মন দেয়। প্রণব দ্বিতীয় দলে।
তালুকদার আবার প্রথম দলে। ফ্রেঞ্চ-টোস্টের পাত্রটা টেনে নিয়ে বলেন, কল্যাণকে চেন? কল্যাণ সেনগুপ্ত, আই. পি. এস.?
–বাঃ। স্যারকে চিনব না? উনি এখন সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টে। দিল্লীতে পোস্টেড। ওঁকে চেনেন বুঝি?
–কল্যাণ আমার ছাত্র ছিল। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়। তারপর আই. পি. এস.।
আহার এবং চা-পানান্তে আবার সেই অনিবার্য অপ্রিয় প্রসঙ্গ। তবে প্রণব জিনিসটা সহজ করে পরিবেশ করল। পকেট থেকে একটা পোস্টকার্ড-সাইজ রঙিন ফটোগ্রাফ বার করে বললে; দেখুন তো স্যার, এ মেয়েটিকে চেনেন?
হ্যাঁ, মালিনীরই। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ–যদি তিনি থাকেন মেয়েটি বিবস্ত্রা নয়। দেখে নিয়ে প্রফেসার তালুকদার ফেরত দেন, হ্যাঁ, চিনি!
–এই মেয়েটিই মোহজাল বিস্তার করে, টেলিফোনে ডেকে আপনাকে ঐ এইট বাই টোয়েন্টি অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যায়। তাই নয়?
নতমস্তকে স্বীকার করলেন মাথা নেড়ে।
–কত টাকা দিয়েছিলেন ওকে?
চমকে চোখে-চোখে তাকান। বলেন, টাকা! না, টাকা তো কিছু দিইনি!
–কিন্তু ঐ মেয়েটির সঙ্গে আপনি তো এক বিছানায় শুয়েছিলেন।
তালুকদার নির্বোধের মতো তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে।
প্রণব স্পষ্টস্বরে বললে, অস্বীকার করে লাভ নেই, স্যার। একটা খামের উপর আপনার নাম-ঠিকানা লেখা। আর ভিতরে আপনাদের দুজনের ছয়খানা ফটোগ্রাফ। আপনি হয়তো খেয়াল করেননি, মেয়েটির শয়নকক্ষে জোরালো বাতি ছিল। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কেউ আপনাদের দু’জনের ফটো তুলেছিল।
তালুকদার দুহাতে নিজের মুখ ঢাকলেন।
–আপনি বলতে চান, ফটোর কথা আপনি আদৌ জানতেন না?
মুখ থেকে হাত সরল না। শিরশ্চালনে জানালেন, উনি তা জানতেন না।
–অর্থাৎ আমার কাছে এইমাত্র জানলেন?
–হ্যাঁ, তাই। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি সেই শয়তানীটা….
–না স্যার! সে শয়তানী নয়! সেও এক হতভাগিনী। ব্ল্যাকমেলিং-এর শিকার। তারও জীবনে একবার পদস্খলন হয়েছিল। আর বাকি জীবন তারই মাশুল দিয়ে চলেছে।
এতক্ষণে সত্যই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন উনি। আর অভিনয় নয়। মুখ থেকে হাতটা সরে গেল। বললেন, মানে?
প্রণব বুঝিয়ে বলে:
মেয়েটি খানদানী বড় ঘরের। পড়াশুনাতেও দুর্দান্ত। য়ুনিভাসির্টিতে পড়ার সময় পদস্খলন হয়। পদস্খলন ঠিক নয়। অপাত্রে বিশ্বাস করা যদি অপরাধ হয় তবে তাই। ছেলেটা ওকে ফেলে পালিয়ে যায়। ওর পরিবারের ধারণা অপহৃতা মেয়েটি মারা গেছে। বাস্তবে ওর একটি পুত্রসন্তান হয়েছিল : জীবন।
তালুকদার চমকে উঠে বলেন, কী বললে? জীবন? জীবক নয়?
–আজ্ঞে না। কেন? জীবক হতে যাবে কেন?
–কিছু না! আমারই ভুল। তারপর?
–ওর ঐ সন্তানটাই হচ্ছে ঐ মস্তান পার্টির ট্রাম্প কার্ড। মেয়েটি যদি কোনো সময় বেশ্যাবৃত্তি করতে অস্বীকৃত হত, তাহলে ওরা ভয় দেখাতো জীবনকে পঙ্গু করে ভিক্ষাজীবী বানিয়ে মায়ের অপরাধের শোধ নেবে। প্রতি মাসে দূর থেকে জীবিত জীবনকে দেখতে পাওয়াই ছিল ওর জীবনধারণের একমাত্র সান্ত্বনা। অবিবাহিত ছোট বোনদের কথা ভেবে সে আত্মপ্রকাশও করেনি।
–মেয়েটি এখন কোথায়, প্রণব?
–সে মুক্তি পেয়েছে। ছেলেকেও পেয়েছে। নিজের পরিবারে সে ফিরে যেতে চায়নি। সোশাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে মা-ছেলের একটা রিহ্যাবিলিটেশানের ব্যবস্থা হচ্ছে। দিল্লীতে। মেয়েটি একটা অরফানেজে চাকরি পাবে…