প্রফেসর তালুকদার তাই আন্দাজ করেছিলেন, নর্দার্ন পার্কে পৌঁছবার পূর্বেই তাঁর ব্যাগটা ছিন্তাই হয়ে যাবে। সেজন্য সাবধানী মানুষটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি নিয়েছিলেন ঠিকই। সেজন্যই সেদিন চাঁদনির বাজারে ওঁকে একজোড়া টর্চের ব্যাটারি কিনতে হয়েছ, ইঁদুরমারা স্প্রিংকল, সোলডারিং তার কিনতে হয়েছে। সেজন্যই দু-দুটো দিন নির্জনকক্ষে সাধনা করতে হয়েছে।
কিন্তু ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মাস্তান নিজেই আসবে টাকাটা ছিনিয়ে নিতে। তাই মোটরসাইকেল আরোহীর অতর্কিত আবির্ভাবটা অপ্রত্যাশিত ছিল না ওঁর কাছে; কিন্তু দাবাবোড়ে-ছকের ও-প্রান্তে ঘোড়ার চালে ওঠশাই কিস্তিটা ওঁর নজরে পড়েনি। উনি ভাবতেই পারেননি, মাস্তান, এভাবে দাবা-ধরে ঘোড়ার চালে কিস্তি দিতে পারে।
তাই বেমক্কা ‘নেপো’র সহকারীর আবির্ভাবে উনি হতচকিত হয়ে পড়েন। মাস্তানকে ডিঙিয়ে দধিভক্ষণমানসে দ্বিতীয় একটি নেপোর আবির্ভাবটা ছিল হিসাবের বাইরে। দুজন যে দুদিকে পালালো! উনি কী করবেন?
কিন্তু সোম-মঙ্গল দু-দুটো দিনের মধ্যে মাস্তান টেলিফোন করল না। নতুন করে পঁচিশ হাজার টাকার দাবীটা পেশ করল না।
কেন? কেন? কেন?
হয় মস্তান, নয় নেপো, একজন না একজন তো তাকে ফোন করবেই। দুজনের মধ্যে যে ফাঁকে পড়েছে।
১৬. মাতা আম্রপালীর উদাত্ত পুকারে
১৬.
গ্যারেজে গাড়িটা তুলে দিয়ে সবে তালা লাগিয়েছেন, বাড়ির দিকে এক পা বাড়াবেন, তখনই ওঁর পাঁজর ঘেঁষে এসে থামল একটা মোটর সাইকেল। না দেখেই ওঁর মনে হল : নেপো। দইয়ের হাঁড়িটা ‘মধুসূদন-দাদার’ ভাঁড়ের মতো বারে বারে ভরে ওঠে কি মা দেখতে এসেছে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন, না, নেপো নয়। কালো কোট গায়ে একজন অপরিচিত যুবক। নেপোকে উনি চেনেন না। তার চোখে ছিল গগলস, মাথায় হেলমেট-এরও তাই; কিন্তু দেহদৈর্ঘ্যে এ সেই নেপোর চেয়ে অন্তত ছয় ইঞ্চি লম্বা। ও–আজকাল তো আবার ছয় ইঞ্চি বলা চলবে না–পনের সে. মি. আর কি!
–প্রফেসর তালুকদার?
–ইয়েস?
–প্রফেসর রঞ্জন তালুকদার, পি. আর. এস.?
–হ্যাঁ তাই। আপনি কে?
মোটর-বাইকটা একপাশে সরিয়ে এগিয়ে এল। সসম্ভ্রম নমস্কার করে এবার নিম্নকণ্ঠে বললে, ডিটেকটিভ-সার্জেন্ট প্রণব মজুমদার, স্যার। আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল।
ভিতরের পকেট থেকে ওর আইডেন্টিটি কার্ডটা বার করে দেখায়।
সাবধানী মানুষটি আলোর নিচে ভাল করে দেখে নিলেন। হ্যাঁ, লোকটা পুলিস বিভাগের অফিসার, এতে সন্দেহ নেই।
–আসুন ভিতরে আসুন।
–আপনি আমাকে ‘তুমি’ই বলবেন, স্যার, কিন্তু ঐ পার্কের দিকে গেলে ভাল হতো না? আমি কিছু… মানে… গোপন কথা জানতে চাইব… হয়তো কিছুটা সঙ্কোচের…
তালুকদার হেসে বললেন, আমি পেশায় মাস্টার মানুষ। বয়সেও তোমার ডবল, আমার কাছে আবার তোমার সঙ্কোচ কিসের, মজুমদার?
প্রণব কেশে গলাটা সাফা করে নিল। তারপর বলল ইয়ে… মানে, সঙ্কোচটা আমার তরফে নয়, স্যার….. মানে, আপনার তরফে…. মিসেস্ তালুকদার কি বাড়িতেই আছেন?
–আছেন। তুমি জান না, তাই প্রশ্ন করছ। মিসেস্ তালুকদার আজ আঠাশ বছর শয্যাশায়ী, পার্মানেন্টলি ইভ্যালিড!
প্রণব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল কয়েকটি মুহূর্ত। তারপর বললে, আয়াম সরি। আমি জানতাম না স্যার, কিন্তু আপনার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতানরা কেউ কি এখন বাড়িতে….
ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে তালুকদার স্লান হেসে বলেন, বিবাহের এক বছরের মধ্যেই আমার স্ত্রী পঙ্গু হয়ে যান, প্রণব, সংসারে আর কেউ নেই। এস, ভিতরে এসে বস।
গাড়ি পার্কিং-এর শব্দ পেয়েই রামু এসে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিল। উনি ডিটেকটিভ সার্জেন্ট প্রণব মজুমদারকে নিয়ে এসে ওঁর স্টাডিতে বসালেন। তার মুখোমুখি বসতে যাবেন তার পূর্বেই রামু ঘোষণা করে, মাইজী বোলাতি হৈঁ!
অগত্যা ফ্যানটা খুলে দিয়ে স্ত্রীর ঘরে চলে আসেন।
শয্যাশায়ী মানুষটির কৌতূহল অফুরন্ত। আর সে কৌতূহল মেটানোর তর সয় না। প্রণতি জিজ্ঞেস করেন, মোটরসাইকেল চেপে কে এল গো?
–ডিটেকটিভ পুলিস-সার্জেন্ট। রামুকে বল, দু’জনের চা-জলখাবার দিয়ে যেতে। আমরা দরজা বন্ধ করে কথা বলব। ও যেন টোকা দেয়।
এ কথাগুলো উনি নিজেই রামুকে বলতে পারেন। সচরাচর বলেন না। প্রণতিকে দিয়ে বলান। অর্থাৎ শুয়ে-শুয়ে যতটা গৃহিণীপনা করা চলে আর কি।
প্রণতি জানতে চান, ডিটেকটিড পুলিস-সার্জেন্ট! ও কেন এসেছে?
–বাঃ! ভুলে গেলে? সেই অসভ্য মাস্তানটা আমাকে টেলিফোনে শাসিয়েছিল, মনে নেই? সেই তার বোন–কী যেন নাম–তাকে পাস করিয়ে দিতে–
প্রণতি বলেন, মালিনী।
–হ্যাঁ, মালিনী। তাই ও এসেছে আমার নিরাপত্তা বিধানে!
–ও আচ্ছা। যাও, আমি রামুকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
এবার বাইরের ঘরে ফিরে এসে ওর মুখোমুখি বসে বললেন, এবার বল মজুমদার, আমার সঙ্কোচ হবার মতো কী কথা বলতে চাও?
–আপনি কি, স্যার, ‘মেঘচুম্বিত’ অ্যাপার্টমেন্টটা চেনেন?
তালুকদারের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সংক্ষেপে বলেন, চিনি।
–মাসখানেকের ভেতর ওখানে গেছেন?
একটু ইতস্তত করে স্বীকার করলেন, গেছি।
-–আট তলার বিশ নম্বর ফ্ল্যাটে? মিস্টার সোন্ধীর অ্যাপার্টমেন্টে?
এবার সরাসরি জবাব দিলেন না। একটু ভেবে নিয়ে বললেন, মজুমদার, ভারতীয় সংবিধানে প্রভিসন্স আছে, পুলিস যদি মনে করে….