মেয়েটি যে ইত্তেফাক-পর্দা ফাঁক রেখেই বসন পরিবর্তন করছিল তা আন্দাজ করতে পারেননি।
কিন্তু এ কী?
এমনটা তো কখনো হয় না। হবার কথাও নয়! চিত্রপ্রদর্শনীতে অথবা ছবির বইতে ন্যূড কি দেখেননি, দেখেন না? এখানে অবশ্য কিছুটা প্রভেদ আছে। মাসিক পত্রিকার মলাটে ওটা হাতে আঁকা ছবি নয়, রঙিন আলোকচিত্র। ফটোগ্রাফিকে যতই জাতে তুলবার চেষ্টা কর, হাতে-আঁকা ছবির আবেদনই আলাদা। সেটা পুরোপুরি আর্ট; আলোকচিত্রের মতো আধা-আর্ট আধা-ক্রাফট নয়। তাই চিত্রে, এমনকি ভাস্কর্যেও ন্যুড যতটা শিল্পমণ্ডিত, আলোকচিত্র ততটা নয়। বিদ্যুৎঝলকের মতো এক নজর দেখেছেন মাত্র; কিন্তু তার মধ্যেই ওঁর মনে হয়েছে প্রচ্ছদপটের মেয়েটি–নাকি মহিলাটি–বিবস্ত্রা ঠিক নয়, সযত্ন-সচেতনতায় অর্ধাবৃতা। লুটিয়ে পড়া আঁচলটাকে সে যখন নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই অসতর্ক মুহূর্তেই অসভ্য ফটোগ্রাফারটা….
কিন্তু একটা কথা!
দোষটা তো পুরোপুরি ক্যামেরাম্যানের ঘাড়ে চাপানো যাবে না সোনামণি! ষড়যন্ত্রের অংশীদার তুমি নিজেও। না হলে শাড়ি পরার পূর্ববর্তী পর্যায়ে তোমার পরিধান করার কথা নয় কি–পেটিকোট-ব্রা-ব্লাউস? আর তাছাড়া লুটিয়ে-পড়া আঁচলটাকে তুলে নেবার ভঙ্গিমার আড়ালে কেমন যেন একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়ে গেল না–কেমন যেন একটা তির্যক প্রয়াস : আবৃত হওয়ার অপেক্ষা সযত্নে অনাবৃত হওয়ার?
অধ্যাপক তালুকদারের কান দুটো একটু গরম হয়ে উঠেছে। স্বপিণ্ডের স্পন্দন ছন্দ তেহাইয়ের বোল না তুললেও বেশ কিছুটা দ্রুত লয়ে….
‘যদা সংহরতে চায়ং কূর্মোহঙ্গানীব সর্বশঃ….’
জানেন, জানা আছে ওঁর। বহির্জগতে কোনও চাঞ্চল্যের লক্ষণ অনুভব করলে। কূর্ম তার হাত-পা-মাথা দেহবর্মের ভিতরে লুকিয়ে ফেলে। স্থিতপ্রজ্ঞ পণ্ডিতও তেমনি তাঁর ইন্দ্রিয়সম্মুখে উপস্থিত চিত্তচাঞ্চল্যের প্রত্যক্ষ হেতুটিকে উপেক্ষা করেন। পঞ্চেন্দ্রিয়কে স্বীয় বশে এনে রাশটানা ঘোড়ার মতো…
তাকিয়ে দেখলেন একবার সামনের দিকে। সর্দারজি একমনে ড্রাইভ করছে। নজর করে দেখলেন ওর ভিয়ু-ফাইভারটিকেও। না, কেউ কোনভাবেই ওঁকে লক্ষ্য করছে না।
চলন্ত ট্যাক্সির গর্ভে তিনি মাতৃগর্ভস্থিত ভ্রূণের মতো একান্ত।
অস্বীকার করার উপায় নেই অধ্যাপক তালুকদারের দ্বৈত সত্তার। তিনি কলেজে ইনঅর্গানিক কেমিস্ট্রির ক্লাস নেন, খাতা দেখেন, রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্টদের ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার দিকে গলফের বলের মতো ঠেলে ঠেলে দেন, ‘ছাত্র-অধ্যাপক কল্যাণ সমিতি’র সেক্রেটারি, কিন্তু সেখানেই তাঁর পরিচয় শেষ হয় না। তিনি লেখক, তিনি ঔপন্যাসিক, তিনি কবি।
অবশ্য ছদ্মনামে। ওঁর মনে হল, ইত্তেফাকের দমবন্ধকরা অন্ধকূপে এতক্ষণে মেয়েটি মুমূর্ষু।
কাগজের তলা থেকে দ্বিতীয়বার উদ্ধার করে আনলেন ওকে। দেখলেন। এবার আর বিদ্যুঝলকে নয়। কত বয়স হবে মেয়েটির? সাতাশ-আঠাশ? বিয়ের সময় প্রণতির যে বয়স ছিল আর কি! প্রায় বিশ-ত্রিশ বছর আগে। তখন তো সে এমন শয্যাশায়ী পঙ্গু ছিল না।
পঁচিশ বছর! উফ্! শতাব্দীর একপাদ!
কিন্তু এ-কথাও তো বিস্মৃত হওয়া চলে না যে, প্রণতি যদি বন্ধ্যা না হত, তাহলে ওঁর নিজেরও এতদিনে ঐ বয়সের একটি কন্যাসন্তান থাকতে পারত!
কথাটা মনে হতেই পাতাটা উল্টে দিলেন।
ত্রৈমাসিক পত্রিকা। নাম ‘পত্রমিতালী’। এটি প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যা। পার্ক সার্কাসের একটি ঠিকানা থেকে প্রকাশিত। পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে : পত্রবন্ধুত্বে আগ্রহী পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়াই এ পত্রিকার মূল লক্ষ্য। বিদেশে নাকি এই জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে বন্ধুত্ব স্থাপন করে অনেকে জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনীর সন্ধান পেয়েছে। অন্তত সম্পাদক তো তাই দাবী করেছেন। তা বলে এখানে শুধু পাত্রপাত্রীর সন্ধানই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। এই জটিল দুনিয়ায় একই চিন্তাধারার দুটি মানুষ তারা নর ও নারী নাও হতে পারে হয়তো দুটি রমণী অথবা দুটি পুরুষ, পরস্পরের কাছে হৃদয়ের ভার নামিয়ে দিয়ে শান্তি পেতে চেয়েছে, সান্ত্বনা খুঁজেছে। মাত্র তৃতীয় সংখ্যার ভিতরেই প্রায় সত্তরটি পত্ৰবন্ধুত্ব প্রার্থী ছেলে ও মেয়ের সন্ধান সম্পাদক-মশাই পেয়েছেন। তাদের, নামের ক্রমানুসারে তালিকাকারে শেষ ফর্মায় সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। পত্রিকায় এ জাতীয় বিজ্ঞপ্তি দিতে গেলে একটা মেম্বারশিপ-ফি দিতে হয়; কিন্তু যারা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে কোনো সাধারণ পাঠক বা পাঠিকা যোগাযোগ করতে চাইলে ফি দিতে হবে না। পত্রমিতালী যারা চেয়েছে তারা শুধুমাত্র এক-একটি ক্রমিক সংখ্যা দ্বারা সূচিত। ‘নাম’ কোনক্ষেত্রেই জানানো হয়নি। তাদের সম্বন্ধে ভাসা-ভাসা কিছু খবর আছে–কত বয়স, পড়াশুনা কত দূর, কী কী হবি, পুরুষ অথবা স্ত্রী। বিবাহিত-অবিবাহিত অথবা বিধবা/বিপত্নীক। ছাত্র, চাকুরে, ব্যবসায়ী অথবা অবসরপ্রাপ্ত। সংসারে তিক্ত-বিরক্ত তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সংসার কর্তৃক পরিত্যক্ত অথবা উপেক্ষিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবরকমই আছে।
কোনো পাঠক বা পাঠিকা যদি কাউকে চিঠি লিখতে চায়, তাহলে বিশেষ সংখ্যাকে সম্বোধন করে চিঠিখানি লিখতে হবে। খামে ভরতে হবে। বন্ধ খামে ডাকটিকিট সেঁটে খামের পিছনে পেনসিলে ক্রমিক সংখ্যাটি লিখতে হবে। এবার একটি বৃহত্তর খামের গর্ভে তাকে ভরে দিতে হবে। ঐ সঙ্গে বড় খামে দিতে হবে স-টিকিট একটি ‘সেলফ অ্যাড্রেস্ড্’ খালি লেফাফা। তারপর বড় খামে সম্পাদকের নাম-ঠিকানা লিখে ডাকে দিতে হবে।