গলির উল্টোদিকে একটা বাড়ির ভেনিশিয়ান খড়খড়ি পাল্লা তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ির ভিতর থেকে কে একজন মুরুব্বি ভারি গলায় হুকুম দিল : কেন বেহদ্দা ঝুট-ঝামেলা করছিস্ বে? বডিটা রোয়াকে নামিয়ে দে, যে পয়দা করেছে সে সালা সমঝে নেবে জিন্দা না মুর্দা। ডাক্তার-মানুস্ এটুকু বুঝবে না?
দু-তিনজন ধরাধরি করে একটা অচেতন নারী-দেহ রোয়াকে নামিয়ে দিল। তারপর ওরা ঐ গাড়ি চেপে চলে যায়।
ডক্টর সেন নেমে এসে মেয়েকে ঘরে তুলে নেন। না, মৃতদেহ নয়। অজ্ঞান হয়েছিল জোরালো ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোতে। বেলা দশটা নাগাদ তার ঘুম ভেঙেছে। তার আগেই একজন পরিচিত লেডি ডাক্তারকে দিয়ে ডক্টর সেন কৃষ্ণাকে পরীক্ষা করিয়ে ছিলেন। তার ঘুমন্ত অবস্থাতেই।
যা আশঙ্কা করা গিয়েছিল! স্টিচ দিতে হয়েছে।
জ্ঞান ফিরে আসার পর কৃষ্ণা কারও সঙ্গে একটা কথাও বলেনি।
কিছু খায়নি পর্যন্ত।
তালুকদার নতনেত্রে শুনছিলেন এতক্ষণ। তাপস থামতেই চোখ তুলে তাকান, বলেন, তারপর? ডক্টর সেন পুলিসকে জানিয়েছেন?
–না, স্যার। তবে পুলিস খবর পেয়ে গেছে।
–সারাদিন সারারাত সে অভুক্ত আছে?
–হ্যাঁ, স্যার। শুধু তাই নয়, মৌনও। এখনো পর্যন্ত সে কোন কথা বলেনি। কোন প্রশ্নের জবাব দেয়নি। ও বোধহয় নির্বাক অনশনে মৃত্যুবরণ করতে চায়!
তালুকদার নীরব রইলেন।
–আপনি স্যার, একবার চেষ্টা করে দেখবেন?
–আমি? আমি কী চেষ্টা করে দেখব? ওর অনশন ভাঙাতে? আমাকে সে কোনভাবে চেনেই না। তার বাবা, ছোট বোন, ভাই যেখানে ওকে রাজি করাতে পারেনি…
–তা বটে।
তালুকদার সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকেন।
তাপসও নীরবতা ভঙ্গ করে না।
যেন অনেক-অনেক দূর থেকে তালুকদার হঠাৎ প্রশ্ন করেন, তাপস! গত বছর আমাদের সোস্যালে কৃষ্ণা কোন্ রবীন্দ্রসঙ্গীতটা গেয়েছিল তোমার মনে আছে?
তাপস জবাব দিল না। বাহুল্যবোধে। এ-কথা কি কারও মনে থাকতে পারে?
তালুকদার বললেন : “দুঃখের বেশে এসেছ বলে তোমারে নাহি ডরিব হে, যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা নিবিড় করে ধরিব হে!”
১৪. টাকা হস্তান্তরিত
১৪.
শনিবার রাত সাড়ে আটটায় যথারীতি টেলিফোন করল লোকটা।
প্রশ্ন মাত্র বিস্তারিত নির্দেশ দিয়ে গেল।
টাকাটা হস্তান্তরিত করতে হবে ভবানীপুরে। নর্দার্ন পার্কে। রবিবার দুপুরে কাঁটায়-কাঁটায় বেলা আড়াইটায়। নর্দান পার্কটা কোথায়? শুনুন বলি : শরৎ বসু রোড ধরে উত্তরমুখো আসছেন দেশপ্রিয় পার্ক থেকে। কেমন তো? পদ্মপুকুরের পরের স্টপেজ চক্রবেড়িয়া। সেখান থেকে জাস্টিস্ চন্দ্ৰমাধব রোড ধরে পশ্চিমমুখো চলতে হবে। বাঁ-হাতি গুজরাতীদের মেটার্নিটি হোম পার হলেন। তার পরেই নর্দার্ন পার্ক। তার উত্তর-পূর্ব কোণের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে। পার্কের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ধুতি পাঞ্জাবি পর দণ্ডায়মান মূর্তি। তাঁর পাদমূলে–একটু দূরে–একটি বেঞ্চি পাতা। উপরে ছাউনি। ভরদুপুরে সেখানে জনমানব থাকবে না। সেখানেই ও প্রতীক্ষা করবে। নেহাৎ ঘটনাচক্রে তখন যদি ওখানে কোনো বেগানা লোক কেউ থাকে তাহলে ও বসে থাকবে আশেপাশের কোনও ফাঁকা বেঞ্চিতে। পরিধানে জীনস্-এর জীর্ণ প্যান্ট, ঊর্ধ্বাঙ্গে পাকা টোম্যাটো রঙের স্পোর্টস গেঞ্জি, পায়ে হান্টিং শু, মাথায় ইলাসটিক ব্যান্ডে বাঁধা পীজবোর্ডের হুড–ক্রিকেট-মরশুমে যা ইডেন-গার্ডেন্সে-এ হাজারে হাজারে দেখতে পাওয়া যায়।
এমন বিচিত্র সাজ-পোশাকে ঐ ভরদুপুরে ঐ পার্কের বেঞ্চিতে দ্বিতীয় ব্যক্তি থাকার সম্ভাবনা নেই। ভুল হতেই পারে না। তবু সাবধানের মান নেই। ছেলেটি প্রফেসর তালুকদারকে চেনে। ওঁকে দেখতে পেলেই এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করবে, ‘কটা বাজে, স্যার? আমার হাত-ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে।’
উনি লক্ষ্য করে দেখে নেবেন ওর হাতে শুধু ব্যান্ডই আছে, ঘড়ি নেই। তখন আদান-প্রদান হবে। ছেলেটি ওঁকে প্রথমে দেবে খোলা খামে এক সেট ছবি। সেটা যাচাই করে নিয়ে উনি বার করে দেবেন রসিদ আর স্ট্যাম্প প্যাড। টিপছাপ দেওয়া শেষ হলে উনি ওঁর কাঁধের ঝোলা-ব্যাগটা থেকে টাকার বান্ডিলটা বার করে দেবেন। সেটা যেন কাগজে ভাল করে জড়ানো ও দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে।
তালুকদার জানতে চান, তুমি বারে বারে, ‘ছেলেটি ছেলেটি বলছ, তার মানে কি বলতে চাও তুমি নিজে আসবে না?
–আজ্ঞে না স্যার। এত বড় মূর্খামি আমি করব না। নিজেই আসব।
–মূর্খামি কেন বলছ?
–ধরুন, আমি রাম-শ্যাম-যদুকে পাঠালাম, আর শালা ফিরে এসে বললে, ‘প্যাকেট তো নিয়ে এসেছি গুরু, কিন্তু তাতে একখানা নোটও নেই। শুধুই পুরনো কাগজ ঠাসা!’ তখন? কী করে বুঝব, কোন শালা তঞ্চকতা করল, আপনি না আমার চ্যালা?
–তার মানে তুমি টাকাটা গুনে নেবে না?
–কেমন করে নেব, স্যার? ভরদুপুরে স্বয়ং নেতাজীর পায়ের তলায় বসে ওখানে ব্ল্যাকমেলিঙের নোট আমি গুনতে পারি? গোনা শেষ হতে হতে তো দেখব স্টেনগানধারী পুলিসে নর্দার্ন পার্ক ছেয়ে ফেলেছে।
–আই সী! কিন্তু আমি যদি তোমাকে পঁচিশের বদলে বিশ দিই?
–বিষ যখন দিতে পারছেন না তখন বিশও দিতে পারেন না। নেগেটিভের হাইড্রোজেন বোমা যে আমার হেপাজতেই রয়ে গেল। বুঝেছেন?
অধ্যাপক তালুকদার নীরবে কী যেন ভাবতে থাকেন।