জনশ্রুতি, ভাগলপুরের জেল-এর জেলার ছিলেন ভিন্ন জাতের পুলিস-অফিসার। লোভে লালায়িত হওয়া অথবা ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া তার স্বভাব-বিরুদ্ধ। কিন্তু কিছু করার নেই। অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত জেলর-সাহেব নাকি একবার ক্ষেপে উঠে ওদের একজনকে বলেছিলেন, তোকে মেরে এই জেলের ভিতরেই পুঁতে ফেলব, শয়তান!
লোকটা ভাগলপুরী দেহাতি-খিস্তি মিশিয়ে জবাবে বলেছিল, সেটা তোর হিম্মতে কুলাবে না রে পুলিসের বাচ্চা! জেলের ভেতর আমার মৌত মানে তোর জরু-গরুও ফৌত! তোকে ফাঁসি কাঠ থেকে না ঝুলিয়ে থামবে না ঠাকুর-সাহেব! না কী বলিস রে ভগলু ভেইয়া?
ওর পাপের সাথী ঠাকুর-সাহেবের আরেকজন পোষা কুত্তা ভগলু অট্টহাসে ফেটে পড়েছিল। বলেছিল, তব শুন লে রে জেলার-সাহব! তোকরা হিসাব হ্যয় নু, কি মেরা উনতালিশঠো কেস হো চুকা? অব শুন……
অর্থাৎ, শোন, রে জেলার-সাহেব। তুই তো জানিস আমার নামে উনচল্লিশটা রেপ-কেস আছে। তাই না? লেকিন তুই যেটা জানিস না সেটা শুনে রাখ। ‘চালিশবারে’র জন্য কোন মনপসন্দকে চুনাও করে রেখেছি। বড়ি খুবসুরৎ! উমর কেৎনা ভইল রে জেলার সা’ব? আঠারা বহ্ বিশ?
দাঁতে-দাঁত দিয়ে জেলার বলেছিলেন, কার কথা বলছিস?
–তেরি লেড়কি কি। কলেজমে সে পড়তি হ্যয় নু?
দুরন্ত ক্রোধে স্থান-ত্যাগ করেছিলেন জেলার সাহেব।
ওরা তিনজন অট্টহাস্য করে উঠেছিল তাঁর পলায়নের ভঙ্গিটায়।
কিন্তু ওরা ঠিক বুঝতে পারেনি।
জেলার পালিয়ে যাননি আদৌ। মনস্থির করেছেন ততক্ষণে। বুঝতে পেরেছেন; এ-ছাড়া তাঁর ফুলের মতো নিষ্পাপ আত্মজার ধর্মরক্ষা করা অসম্ভব। হ্যাঁ, কলেজেই পড়ে –ভাগলপুর কলেজে –সুবো-সাম লেডিজ-সাইকেলে চেপে ভাগলপুর কলেজে যেতে হয় তাকে। ক্যাবিনেট-মন্ত্রীর প্রভাবে ঐ তিনটে নরপিশাচ জামিনে খালাস পাবেই। আর তখন তারা প্রতিশোধ নেবে নির্ঘাৎ! মেয়েটিকে মাঝপথ থেকে তুলে নেওয়া ওদের কাছে ছেলেখেলা। উনতাল্লিশ সে চালিস! ক্যা ফারক?
জেলারকে মদত দিতে এগিয়ে এল আরও পাঁচ-সাতজন পুলিস। তারাও নানান কারণে অন্তর্দ্বন্দ্বে জ্বলছিল। প্রতিশোধস্পৃহায় তারাও ছিল আগ্নেয়গিরি।
তিন-তিনটে আসামী জেলের ভিতর অন্ধ হয়ে গেল!
না, জেলর-সাহেবের উপর থেকে সাসপে্নশন-অর্ডার প্রত্যাহার করা হয়েছিল কি না তা আর জানেন না তালুকদার-সাহেব। কিন্তু এটুকু জানেন, তাঁর ঐ বে আইনি কাজটা শতকরা শতভাগ সমর্থন পেয়েছিল ভাগলপুরবাসীদের কাছ থেকে।
না, এবারও হিসাবে ভুল হয়। শতকরা শতভাগ নয়। কয়েকজন উচ্চকোটির ‘ষড়যন্ত্রী-মশাই’ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ঐ অপরাধব্যবসায়ীরা ছিল যে-কয়জন মুষ্টিমেয় রাজনীতিব্যবসায়ীর পোষাগুণ্ডা। কিন্তু ক্ষমতার চূড়ায় অধিষ্ঠিত ঐ মন্ত্রীমশাইদেরও কিছু করার ছিল না। অবিমৃষ্যকারী জেলারের কেশস্পর্শ করলে আগামী ‘চুনাও’-য়ের সময় গোটা ভাগলপুর অঞ্চলের কয়েক লক্ষ ভোট হারাতে হবে!
জেলার-সাহেব বদলি হয়ে গেছিলেন নিশ্চয়–ঠিক জানেন না। কিন্তু এটুকু আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না তাঁর সেই অষ্টাদশী আত্মজাটি একদিন কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়েছিল–দু-হাতে মেহদির ছাপ নিয়ে একদিন ছাঁদনা-তলায় অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেছিল তার দুলহন-এর দিকে।
এতদিনে বোধকরি সে সোনার চাঁদ খোকার-মা!
কৃষ্ণার কি সে সৌভাগ্য হবে?
১২. মহিম হালদারের বাড়িতে
১২.
হাসপাতাল সেরে মহিম হালদারের আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে গিয়ে যখন পৌঁছালেন তখন পড়ন্ত বিকাল। সাড়ে চারটে। বাড়ির সামনে অনেকগুলি গাড়ি দাঁড়িয়ে। অ্যামবাসাডার, মারুতি, মায় একটি মার্সেডিজ। মহিমবাবু একাধিকবার চুনাওয়ে জয়ী হয়েছেন। দশবছর আগে ইঁটের পাঁজরা বার করা যে একতলা পৈত্রিক বাসভবনে এই রাজনীতির ব্যবসা শুরু করেন, পর-পর দুবার দেশসেবার অধিকার পেয়ে সে বাড়ি আজ ত্রিতল। একতলায় বেশ বড় একটা হল-কামরা। ব্যারিস্টার বা পশারওয়ালা ডাক্তারদের যেমন থাকে। সামনের দিকে একটি প্রতীক্ষাগারে সোফা সেটি-চেয়ার, বেঞ্চি। আর তার পরে অটোমেটিক ডোর-ক্লোজার লাগানো টীক-প্লাই-এর ফ্লাশ-পাল্লার আড়ালে বাতানুকূল-করা সাহেবের চেম্বার–থুড়ি, এক্ষেত্রে ‘দাদা’র খাশ-কামরা।
গাড়ি পার্ক করে তালুকদার-সাহেব তাপসকে নিয়ে প্রবেশ করলেন বাইরের ঘরে। একাধিক সাক্ষাৎপ্রার্থী অপেক্ষা করছে। বাঙালি এবং অবাঙালি। উনি এক ধারে গিয়ে বসলেন। তাপস একই সোফায় বসতে ইতস্তত করছিল। উনি হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলেন।
একটি লক্কা-পায়রা-মার্কা ছেলে এসে বাড়িয়ে ধরল ছাপানো স্লিপ বুক। তালুকদার মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন।
তাপস হাত বাড়িয়ে সেটা নিল। সাক্ষাৎপ্রার্থীর নাম জানালো : ‘প্রফেসার আর. তালুকদার’। প্রয়োজনের ঘরে : ‘অ্যাজ আপয়েন্টেড’।
ছেলেটি কাগজটা নিয়ে ভিতরে গেল।
পরমূহুর্তেই ফ্লাশ-পাল্লাটা খুলে গেল। দুজন যুবক বার হয়ে এল। ডানে-বাঁয়ে তাকালো না। সোজা বেরিয়ে গেল রাস্তায়। ওদের ভিতর একজনকে চিনতে পারলেন তালুকদার-সাহেব। ঐ ছেলেটির ফটোই আছে তাঁর অ্যাটাচি-কেসে। এখন জিন্স্-এর প্যান্ট নয়, গোল-গলা স্পোর্টস্ গেঞ্জিও নেই গায়ে, কিন্তু মাথার উপর পাখির বাসাটি আছে অবিক্ষত। উনি তাপসের দিকে আড়চোখে তাকালেন। তাপসের ঘাড় সোজাই রইল। শুধু চোখ জোড়া ইঙ্গিতপূর্ণভাবে একবার বন্ধ হয়ে খুলে গেল।