–জানি, স্যার। বলছি শুনুন।
তাপস ওঁকে জানালো কৃষ্ণা সেন একজন নামকরা ছাত্র নেত্রী। তাপসদের ইউনিয়নের। ফলে লালটুর বিরুদ্ধ পার্টির। লালটু অবশ্য ছাত্র নয়। সে পার্টি ক্যাডারদের নেতা। প্রয়োজনে কখনো বা কলেজের ছাত্র-রাজনীতিতে অংশ নেয়। যদি কাউকে ‘ধোলাই’ দেওয়ার প্রয়োজন হয়। অথবা ‘হাফিজ’ করার। কিছুদিন আগে কৃষ্ণার সঙ্গে লালটুর রাজনৈতিক দলের একটা ছেলের বচসা হয়। ওরা দাবী করেছিল ওদের কী একটা ফাংশনে কৃষ্ণাকে গান গাইতে হবে। কৃষ্ণা সম্মত হয়নি। বচসার সময় ও দলের একটি ছেলে কৃষ্ণার গায়ে হাত দেয়। আর কৃষ্ণা তাকে একটা চড় মারে। ফলে একটা হাতাহাতির সূত্রপাত হয়। ঘটনাচক্রে সে সময় ওরা দলে ভারী ছিল না। মার খেয়ে পালায়। তাপসের আশঙ্কা, তারপর ওরা ওদের পার্টি-মস্তান লালটুর শরণ নেয়। তা থেকেই এই পরিণতি।
তালুকদার জানতে চান, কৃষ্ণা যে ছেলেটিকে চড় মেরেছিল তা কেউ দেখেছে?
–কী বলছেন স্যার? ঘটনাটা ঘটে কমনরুমের সামনে। অন্তত দশ-বিশজন সাক্ষী আছে। তবে আপনি যা ভাবছেন তা হবার নয়?
–কী ভাবছি আমি?
–যদি কোনও এনকোয়ারি হয়, অথবা আদালতে সাক্ষী দেবার প্রয়োজন হয় তবে প্রত্যক্ষদর্শী একটাও পাবেন না।
–ঐ মস্তান লালটু বিশ্বাসের ভয়ে?
তাপস কিছুক্ষণ নীরব রইল। তারপর বলল, ওর নামে কতগুলো কেস ঝুলছে তার হিসাব বোধকরি লালটু নিজেই জানে না। প্রয়োজনও হয় না। সে হিসাব রাখবার জন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আইন-মোতাবেক মাহিনা-করা ব্যবস্থা করেন। একাধিক খুন, ডাকাতি, রাহাজানি এবং রেপ-কেস-এর নায়ক বুক ফুলিয়ে মটোর সাইকেলে চেপে সারা শহর চষে বেড়োয়। গুণীজন-সম্বর্ধনার আসরে সেজে-গুঁজে মন্ত্রীমশায়ের পাঁজর ঘেঁষে দাঁড়ায়। ওকে অসংখ্যবার পুলিসে ধরেছে–না ধরে উপায় নেই বলেই ধরেছে–চক্ষুলজ্জার খাতিরে, সংবাদপত্রের ছুড়ো খেয়ে যখন ধরতে বাধ্য হয়েছে কিন্তু প্রতিবারেই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কলকাঠি নাড়ায় জামিন পেয়ে বেরিয়ে এসেছে।
–তারপর? আদালতে কেস ওঠে না?
–আজ্ঞে না। তারিখের পর তারিখ পড়ে। যতদিন না প্রত্যক্ষসাক্ষীদের কৰ্জা করা যায়। লোভে পড়ে অথবা ভয়ে, তারা সরে দাঁড়ায়। আদালতের হাজার-হাজার পেন্ডিং-কেস-এর কিছু সংখ্যাবৃদ্ধি হয় মাত্র। তারপর সবাই সে কথা ভুলে যায়। লালটু বুক ফুলিয়ে মটোর সাইকেলে ঘুরে বেড়ায়।
তালুকদার-সাহেবের মনে হল : সবাই কি ভোলে? যে মায়ের জোয়ান ছেলেটা হারিয়ে গেল, যে বিধবার স্বামী আর কোনদিন বাড়ি ফিরে আসবে না, তারাও কি ভুলতে পারে? আর ঐ হতভাগিনীর দল –যাদের সর্বনাশ করে মস্তান পার্টি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়? যারা লোকসমাজে মুখ তুলে আর তাকাতে পারে না। পাছে কেউ পার্শ্ববর্তীর কানে-কানে বলে, হ্যাঁরে, সেই মেয়েটাই!
ওঁর মনে পড়ে গেল, ভাগলপুর জেল-এর একটা ঘটনার কথা। কয়েক বছর আগে সংবাদপত্রে পড়েছিলেন। পড়ে শিউরে উঠেছিলেন। জেলে বিচারাধীন তিনজন আসামীকে পুলিস-হেপাজতে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল! কী নৃশংস কাণ্ড! অবশ্য তার সাতদিনের মধ্যেই অপরাধী পুলিস –ঐ যারা অন্ধ করেছিল –তাদের সাসপেন্সনের অর্ডার এসে যায় উপরমহল থেকে। মায় জেলার স্বয়ং সাসপেন্ডেড!
সবচেয়ে অবাক করা খবর : ভাগলপুরের মানুষ ঐ আদেশনামার প্রতিবাদ করতে সর্বাত্মক হরতাল করে বসল। কোনও রাজনৈতিক দলের ডাকা বন্ধ নয়। সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করছে। স্কুল-কলেজ, আইন-আদালত, দোকান-পাট সব বন্ধ! কী চায় গোটা ভাগলপুরের মানুষ? ওরা চায় ঐ পুলিস অফিসারদের উপর যে সাসপেন্সন অর্ডার দেওয়া হয়েছে তা প্রত্যাহার করতে হবে!
কী আশ্চর্য! কেন? কেন? কেন?
এমন নৃশংস পুলিস-নির্যাতনের…..
সাংবাদিক তদন্ত করে জানালেন : বিচারাধীন আসামীদের প্রত্যেকের নামে দশ বিশটা খুন আর ডাকাতির কেস ঝুলছিল। এক-একজন বিশ-ত্রিশ-চল্লিশটা রেপ কেস-এর আসামী। বিশ্বাস করা কঠিন, তাই নয়? একটা মানুষ অভাবের তাড়নায় বিশবার ডাকাতের দলে নাম লেখাতে পারে, কিন্তু বিশবার বলাৎকারের বীভৎসতায় গা ভাসানোর বিলাস হয় কেমন করে? খোঁজ নিয়ে দেখ, ওদের ঘরে আছে শয্যাসঙ্গিনী। অথবা যারা অর্থের বিনিময়ে দেহদান করে তাদের সঙ্গে আঁতাত! কিন্তু না! তাতে ওদের তৃপ্তি হয় না। রমণীর আর্তনাদেই ওদের পৈশাচিক তৃপ্তি! বীভত্স ওদের রুচি –যাকে বলাৎকার করবে তার স্বামী-সন্তান অথবা সহোদরকে পিঠমোড়া করে থামের সঙ্গে বেঁধে রাখবে, চোখের সামনে।
তবেই না মজা। হি-হি! হো-হো!
সাংবাদিক অনুসন্ধান করে জেনেছিলেন : ঐ তিনজন কুখ্যাত সমাজবিরোধী দশ বারো বছর ধরে ভাগলপুরে তাদের অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। বিত্তবানেরা, ব্যবসায়ীরা মাস-মাস ওদের ‘তোলা’ দিয়ে যায়, অর্থাৎ মাসিক চাঁদা –বিনিময়ে এরা প্রতিশ্রুতি দেয় ওদের ‘গদি’তে, বাড়িতে বা দোকানে এরা ডাকাতি করবে না, ওদের স্ত্রী-কন্যা পুত্রবধূকে তুলে নিয়ে যাবে না। এই ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে সবাই মেনে চলতে বাধ্য হয়েছিল, অপ্রতিবাদে। পুলিসের কিছু করার ছিল না।
হেতুটা সহজবোধ্য। ঐ তিনজন কুখ্যাত সমাজবিরোধী ছিল এমন লোকের পোষা গুন্ডা, যারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তারা শাসক-সম্প্রদায়ের চূড়ামণি –এম. এল. এ., এম. পি., মন্ত্রী, মায় মুখ্যমন্ত্রী! শাসক-সম্প্রদায়ের ক্ষমতা দখলের লড়াই-ভাগাড়ে তারা শকুনির মতো টানাটানি-ছেঁড়াছেড়ি করে। এই তথাকথিত ‘দেশসেবক গুন্ডা’দের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ‘অপরাধজীবী’রা জীবনযাত্রা নির্বাহ করে। হ্যাঁ, এরা অপরাধজীবীই। নিরুপায় পুলিসের জ্ঞাতসারে। অথবা সহযোগী পুলিসের! কখনো কখনো অপরাধজীবীরা হাতে-নাতে ধরা পড়েছে –কিন্তু তৎক্ষণাৎ প্রভাবশালী ‘দেশসেবকেরা’ হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন–ওরা জামিনে ছাড়া পেয়েছে।