–না, না, অপরাধটা কে করেছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু জয়ন্ত যে বলল তিন-তিনটে ছেলেকে রাউডিজম-এর জন্য ধরে এনেছে?
–আজ্ঞে না, আমি সে-কেসটার কথা বলছি না। আমি বলছিলাম অ্যাবডাকশন কেসটার কথা।
–অ্যাবডাকশন! গুড হেভেন্স! অ্যাবডাকশন হল কখন? কে? কোথায়?
–আপনি বরং ও. সির সঙ্গে কথা বলুন।
যন্ত্রটা উনি হস্তান্তরিত করেন।
জয়ন্ত সংক্ষেপে ওঁকে ব্যাপারটা জানাল। অপহৃতা মেয়েটির নাম জানালো। তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর কথাও; কিন্তু তালুকদার-সাহেব এজাহারে যে নামটা লিখবেন বলে কথা দিয়েছেন তার নামোল্লেখ করল না। ও-প্রান্তবাসীর কথা শোনা গেল না। জয়ন্ত শুনে নিয়ে কথা-মুখে হাত চাপা দিয়ে পুনরায় বললে, উনি আপনার সঙ্গে আবার কথা বলতে চান।
–অলরাইট, দাও।
যন্ত্রটা আবার হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করলেন।
মহিম হালদার ওঁকে অনুরোধ করলেন একবার তার বাসায় আসতে। ব্যাপারটা গুরুতর। এখনি ব্যবস্থা করা দরকার।
তালুকদার বললেন, আমি একবার মেডিকেল কলেজে যাব এখান থেকে। আই মীন, এখানে যারা আটক আছে তাদের জামিনের ব্যবস্থা হয়ে গেলেই…
বাধা দিয়ে মহিম হালদার বললেন, না, না, জামিন-টামিন নয়। আমি জয়ন্তকে বলে দিচ্ছি, ওদের পার্মানেন্টলি ছেড়ে দিতে। পুলিস ওসব পেটি-কেস চালাবেই না। তাহলে কখন আপনি আসতে পারবেন?
–অ্যাবাউট সাড়ে চারটে।
–দ্যাট সুটস্ মি ফাইন, থ্যাঙ্ক য়ু।
তালুকদার জয়ন্ত চৌধুরীকে বললেন, ওঁর ঠিকানাটা…
তাপস আর সতীশ প্রায় একসঙ্গে বলে ওঠে, আমরা চিনি।
১১. থানা থেকে বেরিয়ে
১১.
থানা থেকে বেরিয়ে এসে তালুকদারসাহেব বলেন, ওঠ গাড়িতে।
দুজনকে গাড়িতে তুলে নিয়ে ফিরে এলেন কলেজের গেটে। সেখানে এখন এই কোনও উত্তেজনা নেই। যথারীতি যানবাহন। আর পদাতিকের কসরৎ চলছে –কে কার আগে যেতে পারে। কে বলবে, তিন-চার ঘণ্টা আগে এই রাস্তায় একটা বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে, একটি যুবক ছুরিকাহত হয়েছে, আর একটি তরুণীর আর্ত কণ্ঠস্বরে ট্রাম রাস্তা মুখর হয়ে উঠেছিল! সর্বসমক্ষে টানতে টানতে দুঃশাসনের দল তাকে টেনে নিয়ে গেছে মরণাতীত যন্ত্রণার নরকে!
কলেজ-গেট-এর কাছে এসে উনি গাড়িটা কার্ব ঘেঁষে দাঁড় করালেন। বললেন, আমি এবার একবার মেডিকেল কলেজে যাব। তোমরা কে কী করবে?
সতীশ বলে, এখন তো ভিজিটিং আওয়ার নয়, আপনাকে যেতে দেবে?
–দেবে। ওখানকার দু-একটি ডাক্তার আমার ছাত্র। সতীশ, তুমি বরং এখানে নেমে যাও। খোঁজ নিয়ে দেখ, জোয়াদ্দার এসেছে কিনা। ইতিমধ্যে। এসে থাকলে তাকে আপটুডেট খবরটা জানাও। আর প্রিন্সিপাল-সাহেবকেও জানিয়ে দিও যে, ছাত্র তিনজন হাজত থেকে ছাড়া পেয়ে গেছে– জামিনে নয়, পুলিস আর তাদের বিরুদ্ধে কেস চালাবে না। কেমন?
সতীশ গাড়ি থেকে নেমে গেল। তালুকদার তাপসকে নিয়ে আবার গোলদিঘিকে পাক মারলেন। পাঁচ-দশকের পুরাতন একটি সরবতের দোকানের সামনে এসে গাড়িটাকে থামালেন। উনি নিজে যখন প্রেসিডেন্সিতে পড়তেন তখন এখানে পাশাপাশি দুটি সরবতের দোকান ছিল –প্যারাডাইস আর প্যারাগন। তারই একটা ভগ্নাংশ আজও টিকে আছে। পড়ন্ত বেলায় এখন খদ্দের নেই। উনি তাপসকৈ নিয়ে পিছনের একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন। বললেন, তেষ্টাও পেয়েছে, আর তোমার সঙ্গে জরুরি কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই।
একজন ছোকরা মতো দোকানের কর্মচারী এসে ফ্যানটা খুলে দিয়ে গেল। তালুকদার ওকে দুটো ‘মালাই’ দিতে বললেন।
ছোকরা চলে যেতেই তাপস বলে ওঠে, আমারও একটা প্রশ্ন জানবার আছে, স্যার। আপনি অনুমতি দিলে সেটাই আগে পেশ করি।
–কর। প্রশ্ন করতে আর দোষ কি? জবাব দেব কি না সেটা যখন আমার মর্জির উপর নির্ভর করছে। বল?
–তিনটে কাগজের মধ্যে কটায় ‘লালু বিশ্বাস’-এর নাম ছিল?
–একটাতেও নয়। একটি কাগজে ইংরেজিতে লেখা ছিল এল. এ. এল. টি. উ.। আর একটিতে এল. এ. এল. এল. ইউ.। আর তৃতীয় কাগজে ‘নাম জানি না। তবে এ অঞ্চলের কুখ্যাত অ্যান্টিসোশাল। দেখলে চিনতে পারব।’–এই কথা কটা গোটা গোটা বাংলা হরফে লেখা।
–আপনি কি স্যার, ওকে দেখলে চিনতে পারবেন?
–না। অ্যান্টিসোশালদের ছবি সংগ্রহ করার বাতিক আমার নেই।
তাপস জবাব দিল না। হাসল না পর্যন্ত। তার কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা পত্রিকা বার করে একটা পাতা মেলে ধরল।
তালুকদার দেখলেন, কী একটা ক্লাবের সেটা কালীপূজোর স্যুভেনির। তার প্রথম দিকে গোটা কতক আলোকচিত্র। পূর্ববৎসরের প্রাক-পূজা অনুষ্ঠানের। ছবিগুলি ‘গুণীজন সম্বর্ধনা’-র। কয়েকজন প্রখ্যাত খেলোয়াড়, সঙ্গীতজ্ঞ, সাহিত্যিক প্রভৃতিকে দেখা যাচ্ছে পর-পর ছবিতে, একই মন্ত্রীমশায়ের হাত থেকে স্মারক-সম্মান গ্রহণ করতে। প্রতিটি আলোকচিত্রেই মন্ত্রীমশায়ের পাঁজর ঘেঁষে একজন স্বাস্থ্যবান যুবক দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় দেহরক্ষীর ভঙ্গিতে। তার পরনে জিনস-এর প্যান্ট, উর্ধ্বাঙ্গে গোল-গলা স্পোর্টস গেঞ্জি, মাজায় চওড়া বেল্ট। গোঁফ-দাড়ি কামানো। মাথায় পাখির বাসার মতো সযত্নবিন্যস্ত কেশচুড়।
তাপস তার তর্জনীটা ঐ ছেলেটির বুকের উপর চেপে ধরে বললে : এই হচ্ছে লালটু বিশ্বাস।
দোকানের ছেলেটি দু গ্লাস সরবৎ হাতে এগিয়ে আসছিল। তালুকদার নিঃশব্দে তাপসের হাত থেকে পত্রিকাটা নিয়ে অ্যাটাচি-কেসে ভরে ফেললেন। গ্লাস দুটো নামিয়ে রেখে ছেলেটি চলে যেতেই তালুকদার প্রশ্ন করেন, কৃষ্ণাকে কেন ওরা ধরে নিয়ে গেল, তা জান?