তালুকদার প্রশ্ন করে জানতে পারেন, রিকশাওয়ালার আঘাত সামান্যই। ফার্স্ট এইড নিয়ে ছাড়া পায়। কিন্তু দেবু, রতন ও জলিল–অর্থাৎ যে ছেলেদুটি বোমার আঘাতে ধরাশায়ী হয়েছিল তাদের সবাইকেই মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে।
–পুলিস কখন আসে? কে পুলিশে খবর দেয়? আর অ্যারেস্ট হয়েছে যে তিনজন তাদের নামগুলো কী?
এবার অনেকেই ওঁকে সাহায্যে করতে পারে। কারণ এসব ঘটনা ঘটেছে আধঘণ্টা পরে। তখন বহু ছাত্রছাত্রী উপস্থিত হয়েছিল।
সতীশ তার নোটবুকে সব কিছু লিখে নিল। তালুকদার কিছুই লিখলেন না।
সব প্রশ্ন-উত্তরের পর তালুকদার বললেন, এবার তোমাদের যে প্রশ্নটা করছি তার জবাব ভেবেচিন্তে দিও। আমি বিশেষ করে তোমাদের তিনজনকে বলছি, যে তিনজন অ্যাবডাকশান কেস-এর প্রত্যক্ষদর্শী। যে কয়জন গুণ্ডা কৃষ্ণাকে অপহরণ করে নিয়ে গেল সেই অ্যান্টিসোশালদের মধ্যে কাউকে কি তোমরা চিনতে পেরেছিলে? থিংক বিফোর য়ু আনসার।
একটা অস্বস্তিকর নীরবতা। তিনজনই পরস্পরের দিকে তাকায়। যেন চোখে চোখে কথা হয়ে যায়।
অবশেষে ছেলেটি বলে ওঠে, আমি একজনকে চিনি, স্যার!
হঠাৎ রবি উঠে দাঁড়ালো। যদিও বসে-বসেই এতক্ষণ জবাব দিচ্ছিল, কথা বলছিল। বোধ করি এবার উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে। বললে, আমিও একজনকে চিনতে পেরেছি–ঐ যার কবজি কামড়ে দিয়েছিল কৃষ্ণা।
–আর তুমি? নিবেদিতা?
হাতিবাগানের মোড়ের বাসিন্দার মাথাটা এতক্ষণ ছিল বুকের উপত্যকায়। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, তালুকদার-সাহেব তাকে নামে চেনেন। ধীরে-ধীরে এবার সেও উঠে দাঁড়ায়। বলে, আমিও তাকে চিনতে পেরেছিলাম, স্যার। তাছাড়া যে গাড়ি চালাচ্ছিল তাকেও।
আবার একটা অস্বাভাবিক নীরবতা।
সতীশ জানতে চায়, হোয়াটস্ য়োর নেকস্ট কোশ্চেন, স্যার?
তালুকদার তাকে বলেন, তুমি অত উতলা হয়ে উঠেছ কেন, সতীশ? এনকোয়ারিটা আমিই তো কনডাক্ট করছি, নাকি? আমাকে ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ করতে দেবে না? তুমি কি এতই নির্বোধ যে, বুঝতে পার না এদের নিরাপত্তার কথাও আমাকে ভাবতে হচ্ছে?
সতীশ অধোবদনে নীরবে অপেক্ষা করে।
তালুকদার বলেন, তোমরা তিন জনে তিনটে কাগজে সেই অ্যান্টিসোশালের নাম ব্লক ক্যাপিটালে লিখে আমার হাতে দাও।
আবার ওদের চোখে-চোখে কথা হল। মনে হল, ওরা নির্দেশটা মেনে নিতে রাজি হল। তিনজনে তিনটি কাগজে কী লিখে ওঁকে দিয়ে এল। তালুকদার তিনটি কাগজের টুকরোকে একইভাবে ভাঁজ করলেন। তারপর কড়িখেলার সময় যেমন মুঠোয় করে কড়িগুলোকে ঝাঁকাতে হয় সেইভাবে ঝাঁকিয়ে টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। হেসে বললেন, কে কোন নাম লিখেছ তা আর জানবার উপায় নেই, তাই না? ঠিক আছে, এবার দেখি কাগজগুলোয় কী লেখা আছে!
ভাঁজ খুলে তিনটি কাগজের লেখা পড়লেন। তারপর তাঁর লেকচার টেবলের প্রান্তে বুনসেন বার্নাটা জ্বেলে কাগজ তিনটি তার নীল শিখায়–যাকে বলে উত্তপ্ততম অংশ–মেলে ধরলেন।
সতীশ উঠে দাঁড়ায়। উত্তেজিত ভাবে বলে, এ কী করছেন, স্যার? য়ু কান্ট ডেস্ট্রয় এভিডেন্স!
–এভিডেন্স! কীসের এভিডেন্স? কোন কাগজটা কার লেখা তাই তো আমি জানি না। চল, আমার তদন্তের কাজ শেষ হয়েছে। আমরা এখান থেকে প্রথমে যাব থানায়। তিনটি ছাত্রের জামিনের ব্যবস্থা করতে। এবং অ্যাবডাকশান কেসটা ডায়েরি করতে। তারপর একদল যাবে কৃষ্ণার বাড়ি। সে দলে নিবেদিতা তুমি থাকবে। আর একদল যাবে মেডিকেল কলেজে জলিল, রতন আর দেবু কেমন আছে। খবর নিতে। তাপস তুমি এস বরং আমার সঙ্গে। আর সতীশ তুমি অফিসে যাও, দেবু, রতন আর জলিলের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে তাদের বাড়িতে খবর দাও…
–আমি আপনার সঙ্গে থানায় যাব না?
–কী দরকার? দেবু বোস রতন মুখুজ্জে আর জলিল হুসেন এর বাড়িতে খবর দেওয়াটাও তো জরুরী।
–না, স্যার। আমি আপনার সঙ্গে থানাতেই যাব। ওদের তিনজনের বাড়িতে খবর দেবার ব্যবস্থা আমি নিশ্চয় করব। এখনই! কিন্তু জোয়াদ্দারদা নেই, ইউনিয়ানের তরফে আমার থানায় যাওয়াটা কর্তব্য।
–অল রাইট। তাই যদি তুমি মনে কর, তাহলে তুমিও এস।
তাপস জানতে চায়, একটা ট্যাক্সি ধরব, স্যার?
–না, আমার গাড়িটা হিন্দু স্কুলের সামনে পার্ক করা আছে। আমরা তাতেই যাব।
১০. ও. সি. জয়ন্ত চৌধুরী
১০.
ও. সি. জয়ন্ত চৌধুরী ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমাকে ‘তুমিই’ বলবেন স্যার, আমিও ঐ কলেজের ছাত্র। দশ বছর আগে পাশ করে বেরিয়েছি। তবে আমি ছিলাম আর্টস্ বিভাগে, তাই আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না।
তালুকদার বললেন, তাহলে তো ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল। আমরা সবাই একই কলেজের। আমার সঙ্গে যে দুজন এসেছে এরা দুই ছাত্রনেতা।
–বলুন, স্যার, কী করতে পারি আমি?
–কলেজের তিনটি ছাত্রকে তোমার পুলিস তুলে এনে হাজতে পুরেছে…
বাধা দিয়ে ও.সি. বলে, কলেজের ভিতর থেকে?
–না। কলেজ স্ট্রিটের ট্রাম-রাস্তা থেকে। গেটের সামনে থেকে। তাদের কী অপরাধ? কেন তাদের অ্যারেস্ট করা হল?
–রাউডিজম। সরকারী সড়কের উপর দাঁড়িয়ে মারামারি করা।
–আমরা এসেছি তাদের জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে।
–নিয়ে যান। আপনি যদি তাদের সনাক্ত করেন এবং পার্সোনাল বন্ড দিতে রাজি থাকেন। তবে একটা কথা : পার্সোনাল বন্ডে তাদের মাত্র চব্বিশ ঘন্টার জন্য হাজতের বাইরে রাখতে পারবেন। কাল সকাল দশটার সময় একজন ফার্স্টক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পুনরায় ওদের জামিন নিতে হবে। সেখানে আমি নিজে উপস্থিত থাকব। জামিন নেবার জন্য কোথায় যেতে হবে তাও আমি বলে দেব।