তালুকদার বলেন, আমি কিছু ক্লাস নিচ্ছি না। তোমাদের যা জিজ্ঞাসা করব, তার জবাব বসে বসেই দিও। নাউ ফার্স্ট কোশ্চেন : সকালবেলার ঘটনার–আমি অ্যাবডাকশান কেসটার কথা বলছি–প্রত্যক্ষদর্শী কে কে? স্বচক্ষে মেয়েটিকে অপহরণ হতে দেখেছ কে কে? প্লীজ রেজ য়োর হ্যান্ডস্।
সামনের বেঞ্চি থেকে দুটি মেয়ে এবং একটি ছেলে হাত তুলল।
অধ্যাপক তালুকদার তাদের নাম বা রোল নম্বর জানতে চাইলেন না। বরং পেশ করলেন তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্ন : যে ছাত্রীটিকে ওরা তুলে নিয়ে গেছে তাকে তোমরা কেউ চেন?
প্রথম সারির যে দুটি মেয়ে ইতিপূর্বে হাত তুলেছিল তাদের মধ্যে একজন উঠে দাঁড়ায়। শ্যামলা রঙ, সালোয়ার-পাঞ্জাবি পরে এসেছে। বললে, আমি চিনি, স্যার। আমরা এক পাড়াতেই থাকি। হাতিবাগানের কাছাকাছি। একই ট্রামে আসছিলাম। রুবি উঠেছিল হেদোর কাছে…
–রুবি কে?
ঐ শ্যামলা রঙের মেয়েটির ঠিক পাশেই বসেছিল আর একটি মেয়ে। সেও প্রথম প্রশ্নে হাত তুলেছিল, এবারও তুলে আত্মঘোষণা করল।
–বুঝলাম। তোমরা তিনজনে একই ট্রামে আসছিলে। কিন্তু আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম অ্যাবডাক্টেড মেয়েটির নাম….
–কৃষ্ণা সেন, থার্ড-ইয়ার, ফিলজফি অনার্স।
ভ্রূকুঞ্চন হল অধ্যাপক তালুকদারের। বললেন, কৃষ্ণা সেন? ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়? গতবছর স্যোসালে….
–ইয়েস স্যার! সেই কৃষ্ণাই।
–বলে যাও….
মেয়েটি বর্ণনা করে–
ট্রাম থেকে নেমে ওরা কীভাবে ট্রাম রাস্তা অতিক্রম করতে থাকে। তিনজনই একসঙ্গে। হঠাৎ উল্টোদিক থেকে একটা ট্রাম এগিয়ে আসে। কৃষ্ণা চট করে পার হয়ে যায়। ওরা দুজন এপারে থেকে যায়। কিন্তু ট্রামটা ওদের দৃষ্টিপথ অক্রিম করার আগেই ওপাশে কী একটা গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। ট্রামের প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় মাঝখানে যেটুকু ফাঁক আছে তার মধ্যে দিয়ে ওরা দেখতে পায় দুজন গুণ্ডা কৃষ্ণার দুই হাত ধরে টানছে ফুটপাতের দিকে। ব্যাপারটা কী হয়েছে। জানবার জন্য ওরা দুজন ট্রামটার পিছন দিয়ে ছুটে ওপারে যায়। ততক্ষণে গুণ্ডারা জোর করে কৃষ্ণাকে গাড়িতে তুলছে। তিন-চারজন ছাত্র বাধা দিতে ছুটে আসে। তখন ড্রাইভারের পাশের সীটে বসে-থাকা একজন গুণ্ডা তাদের লক্ষ্য করে পরপর দুটি বোমা ছোড়ে। একটা ফাটেনি, দ্বিতীয়টাও কারও গায়ে লাগেনি, কিন্তু ট্রামরাস্তায় পড়ে সশব্দে ফেটে যায়। দুজন ছাত্র রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। তখন ধোঁয়ার প্রাবল্যে সামনে কী ঘটছে দেখা যাচ্ছিল না। ধূম্রজাল অপসারিত হবার পর ওরা দেখতে পায় রাস্তায় দুজন ছেলে পড়ে কারাচ্ছে। কৃষ্ণার কাঁধের ব্যাগটা মাটিতে পড়ে আছে। আর রাস্তার ওদিকে যে কালো রঙের অ্যামবাসাডার গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল সেটা নেই। মেয়েটি কৃষ্ণার ব্যাগটা তুলে নেয়। লক্ষ্য করে দেখে, দশ-পনেরজন ছাত্র ছুটে যাচ্ছে আহত দুজনকে পাঁজাকোলা করে সরিয়ে আনতে। রাস্তায় জন ও যান চলাচল থমকে গেছে। মুহূর্তমধ্যে বহু মানুষের ভিড়ে রাস্তাটা ভরে যায়। ও আর কিছু জানে না। কৃষ্ণার ব্যাগটা এখনো ওর জিম্মায়। তুলে দেখায়।
তালুকদার এবার রুবির দিকে ফিরে বলেন, ও যা বলল তা তুমি কি সব করবোরেট করছ, না ও কিছু ভুল বলেছে?
–না, স্যার। আমিও ঠিক তাই দেখেছি।
তালুকদার এবার ছেলেটির দিকে ফিরে বলেন, আর তুমি?
সে কিছু বলার আগেই সতীশ সামন্ত বলে ওঠে, ওর পরিচয়টা জানি না, স্যার। তোমার নাম? কোন ইয়ার?
তালুকদার নজর করে দেখলেন, সতীশ একটা খাতায় কী সব নোট নিচ্ছে। তিনি বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, সতীশ, প্লিজ ডোন্ট ডিস্টার্ব মি! এখানে আমিই এনকোয়ারিটা কনডাক্ট করছি। তোমাদের ইউনিয়নের তরফে যদি পৃথক কোন তদন্ত তোমরা করতে চাও তাহলে দেবাশীষ এসে পড়লে তা তোমরা পৃথকভাবে করতে পার।
প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে যে ছেলেটি দাবী করেছিল তার দিকে ফিরে তালুকদার পুনরায় একই প্রশ্ন করেন, আর তুমি?
–আমি স্যার রাস্তার এপাড়ে ছিলাম। ফলে স্মোকস্কৃনে আমার দৃষ্টিপথ আড়াল হয়নি। আমি দেখেছিলাম গাড়ির ভিতর দুজন ছিল। দুজনেই ড্রাইভারের সীটে। পিছনের সীটটা খালি। তা থেকেই ঐ তিনজন অ্যান্টিসোশাল নেমে এসে কৃষ্ণাকে চেপে ধরে। টানাটানি করে পিছনের সিটে তোলে। কৃষ্ণার ব্যাগটা হাত থেকে পড়ে যায়। সে আপ্রাণ লড়াই করে। ইনফ্যাক্ট, লাল… আই মীন যে ছেলেটি ওর ডান হাত ধরে টানছিল তার কবজিতে এক কামড় বসিয়ে দেয়। লোকটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে। ঠিক তখনই দেবু ঐ গুণ্ডাটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার চোয়ালে প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুষি মারে….
তালুকদার সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়েন। বলেন, কী নাম বললে? দেবু?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, দেবব্রত বসু।
–ফোর্থ ইয়ার? ফিজিওলজি?
সতীশ জানতে চায়, চেনেন স্যার ছেলেটিকে?
তালুকদার জবাব দেন না। সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন।
যে ছেলেটি জবানবন্দি দিচ্ছিল সে আবার শুরু করে, দেবু ওর চোয়ালে ঘুষিটা কষানোর সঙ্গে সঙ্গে ঐ লোকটার পাশ থেকে আর একজন অ্যান্টিসোশাল দেবুর তলপেটে ছোরা বসিয়ে দেয়। দেবু রাস্তায় পড়ে যায়। ঠিক তখনি অ্যামবাসাডারটা চলতে থাকে। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সে সামনের দিকে বেরিয়ে যায়। একটা রিকশাকে ধাক্কা মেরে উল্টে দিয়ে।