তিন-চার মিনিটের মধ্যেই সমস্ত ঘটনাটা ঘটে যায়। ঠিক তারপরেই কলেজ গেটের সামনে মারামারি বেধে যায়। দুই রাজনৈতিক দলের সহানুভূতিশীল ছাত্রদের মধ্যে। একটু পরেই পুলিস ভ্যান এসে যায়। তাপসদের পার্টির তিনটি ছেলেকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায়। অতি সংক্ষেপে এই হল ঘটনার বিবরণ।
–তাহলে প্রিন্সিপাল-সাহেব ঘেরাও হলেন কেন?
–উনি ছেলেদের জামিনের ব্যবস্থা করছেন না বলে। বলছেন, পুলিসে যাদের অ্যারেস্ট করেছে তারা রাস্তায় ছিল, কলেজ-ক্যাম্পাসের ভিতরে নয়। ফলে তারা ছাত্র না, সাধারণ নাগরিক….
–অলরাইট! এস আমার সঙ্গে–
–না, স্যার। আপনি ওদিকে যাবেন না। তাহলে আপনিও ঘেরাও হয়ে যাবেন। আমি ঠেকাতে পারব না।
–তুমি ভুলে গেছ তাপস, ‘ছাত্র-শিক্ষক কল্যাণ সমিতি’ বলে একটা সংস্থান আমরা এই কলেজে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, আর আমি তার প্রেসিডেন্ট। তুমিও আছ সেই কমিটিতে। এস, আর কথা বাড়িও না।
প্রিন্সিপাল-সাহেবের ঘরে তিল-ধারণের ঠাঁই নেই। সবাই এক সঙ্গে কথা বলতে চায়, ফলে কারও কথাই শোনা যাচ্ছে না। তদুপরি মাঝে মাঝে ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি। প্রিন্সিপাল হাত নেড়ে ছেলেদের কিছু বোঝাতে চাইছেন, তার একটা শব্দও শোনা যাচ্ছে না। অন্তত এতদূর থেকে।
তালুকদার-সাহেব চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাপস ওঁর ভিতরে ঢোকার পথ করে দেবার চেষ্টা করে। কেউ কেউ তাঁকে দেখে নিজে থেকেই সরে যায়। দু-একজন এদিকে ফেরে।
তালুকদার ছাত্রবয়সে অভিনয় করতেন নাটকে। ‘টপ-ভয়েস’ কীভাবে নিক্ষেপ করতে হয় সে কায়দাটা ভুলে যাননি। সেই উচ্চগ্রাম কণ্ঠস্বরে তিনি বজ্রনির্ঘোষে হাঁকাড় পারেন, কমরেডস্! প্লীজ লেন্ড মি দাইন ইয়ারস্!
মন্ত্রের মতো কাজ হল তাতে। চিৎকার চেঁচামেচি একদম থেমে গেল। ঘরশুদ্ধ সবাই দ্বারপথে দৃকপাত করে এই নতুন অভিনেতার দিকে। অপেক্ষাকৃত নিম্ন স্বরে কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে তালুকদার-সাহেব ইংরেজিতেই বলে চলেন, আশা করি তোমরা সবাই আমাকে চেন… না, না রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক পরিচয়ের কথা বলছি না আমি… তোমরা জান যে, দুঃসময়ে যৌথব্যবস্থা নেবার সুবিধা হবে বলে আমরা এ বছর একটি ‘ছাত্র-শিক্ষক কল্যাণ সমিতি’র প্রতিষ্ঠা করেছি। আমি সে কথাই বলছি। তোমরা জান, আমি সেই সমিতির সভাপতি!… কমরেডস! আমি এইমাত্র কলেজে এসে জানতে পেয়েছি যে, ঘণ্টা-কতক আগে কলেজ গেট-এর কাছে-কলেজ ক্যাম্পাসের ভৌগোলিক সীমানার ভিতরেই হোক, অথবা বাইরে–পরপর কয়েকটি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। যার ফলে কলেজের একটি ছাত্রীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোথাও যেতে হয়েছে, তিনজন ছাত্র আহত হয়ে হাসপাতালে এবং তিনজন ছাত্রকে পুলিসে গ্রেপ্তার করেছে। এর প্রতিবিধানের জন্য আমি এই মুহূর্তেই আমাদের সমিতির একটি কার্যকরী সভার আহবান জানাচ্ছি। সবাইকে খবর দেবার সময় নেই। ঐ কমিটির যে কয়জন সভ্য-সভ্যা এখানে উপস্থিত আছ তারা আমার সঙ্গে রসায়ন বিভাগে লেকচার থিয়েটারে চলে এস। আর যারা ঐ দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী তারাও চলে এস। …. একটা কথা, কমরেডস্। আমাদের এই কলেজ এশিয়ার মধ্যে একটি সুবিখ্যাত ঐতিহ্যময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান… এর মর্যাদা রক্ষা করার দায় তোমাদের, দায় আমাদের! …যারা সত্যিই এ অন্যায়ের প্রতিকার করতে চাও, তারা আমার সঙ্গে চলে এস, আর যারা শুধু খ্যাপা কুকুরের মতো ঘেউ-ঘেউ করতে চাও তারা প্রিন্সিপাল-সাহেবকে ঘিরে ‘হাউল’ করতে পার।
একতরফা বক্তব্যটা পেশ করে মুহূর্তমধ্যে উনি চলতে শুরু করলেন।
যেন, হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা। গোটা দলটা তার পিছু নিল। কিছুদূর এগিয়ে উনি আবার থেমে পড়েন। পিছন ফেরেন। পশ্চাতে অনুসরণকারী ছাত্রছাত্রীদের সম্বোধন করে বললেন, সবাই এসে ভিড় করলে কোন কাজ করা শক্ত হবে। শোন, যারা ঐ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং যারা ঐ ছাত্র-শিক্ষক কল্যাণ সমিতির সভ্য-সভ্যা তারাই শুধু আমার সঙ্গে এস। বাদবাকি ছাত্রছাত্রীদের আমি ক্লাসে যেতে বলছি না, এই মানসিক অবস্থায় সেটা সম্ভবপর নয়। তোমরা মাঠে অপেক্ষা কর। আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এসে আমরা আমাদের কার্যকরী সিদ্ধান্ত জানাব। তোমরা তাতে সন্তুষ্ট না হলে আমাকে ঘেরাও করতে পার, পুনরায় প্রিন্সিপাল-সাহেবকে ঘেরাও করতে পার, অথবা আমাকে ‘ফিজিক্যালি অ্যাসল্ট’ করতে পার। কিন্তু প্লীজ কমরেডস, ডোন্ট স্টার্ট হাউলিং এগেন!
গটগট করে এগিয়ে গেলেন এরপর কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের দিকে। ওঁর অনুসরণকারী দলের অধিকাংশই মাঠের দিকে চলে গেল। জনা আট-দশ ওঁর অনুগমন করল।
লেকচার থিয়েটারে ডায়াসের উপর উঠে ওঁর নজর হল সামনের বেঞ্চিতে জনা দশেক উপস্থিত। চারজন ছাত্রী ছয়জন ছাত্র। তার ভিতর তাপস মিত্র আছে, আছে। সতীশ সামন্তও। সতীশ এখন ইউনিয়ানের অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি। ওদের পার্টিই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরা দুজনেই ছাত্র-শিক্ষক কল্যাণ সমিতির সদস্য। কিন্তু দেবাশীষ জোয়াদ্দারকে দেখতে পেলেন না ইউনিয়ন-ইন-পাওয়ার এর সেক্রেটারি। তাই সতীশকে প্রশ্ন করলেন, দেবাশীষকে দেখছি না। আসেনি?
সতীশ উঠে দাঁড়ায়। বলে, না স্যার। কী জানি কেন আজ সে অ্যাবসেন্ট। আমি ওকে বাড়িতে খবর পাঠিয়েছি।