পাবলিক-বাস ধরবার চেষ্টা করা অহেতুক। নাকের সামনে দিয়ে একটা ডবল-ডেকার বাদুড়ঝোলা অবস্থায় ‘কাকে-খাই কাকে-খাই’ করতে করতে বেরিয়ে গেল। মনস্থির করলেন : ট্যাক্সিই নিতে হবে। কিন্তু ট্যাক্সি ধরা কি অতই সোজা, এই পড়ন্ত বেলায়? যখন এই এত-ভঙ্গ বঙ্গ দেশটার রঙ্গভরা কেরানিকুল ঘরে ফেরার তাগাদায় জানকবুল। লাখ-লাখ বিল্বমঙ্গল ঠাকুর চলেছে ঘরমুখো। লোডশেডিং-এর আঁধারে চিন্তাকুল চিন্তামণির দল অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষমাণা। তাই ওরা টের পায় না–কী চেপে ধরে ঝুলতে ঝুলতে বাড়ি ফিরছে বাসের হ্যান্ডেল না অজগর সাপ! আর এই মওকায় ট্যাক্সিওয়ালারা সাময়িক ‘আবু হোসেন’–আড়াই ঘণ্টার ‘হঠাৎ নবাব’।–’কোথায় যাবেন স্যার?’ অর্থাৎ যদি তুমি ওর গন্তব্যস্থলের দিকে দু-কদম এগিয়ে যেতে চাও শুধু তাহলেই কিঞ্চিৎ অর্থমূল্যের বিনিময়ে সে তোমাকে একটা লিফট দিলেও দিতে পারে। কেউ কেউ আবার সাঁঝের ঝোঁকে রূপান্তরিত হয়ে যায় শেয়ারের ট্যাক্সিতে। আবার বেশ কিছু ড্রাইভার হাওড়া স্টেশান বা এয়ারপোর্ট ছাড়া অন্যত্র পাদমেকং নগচ্ছামঃ।
হঠাৎ একটি সুদর্শন ছেলে এগিয়ে এসে বলে, আজ গাড়ি আনেননি স্যার?
নির্ঘাৎ কলেজের। কোন ইয়ার? মুখটা চেনা-চেনা। বললেন, না, আজ গাড়ি আনিনি। একটা ট্যাক্সি ধরব ভাবছি; কিন্তু…
–আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন। আমি ধরে দিচ্ছি। বাড়িই ফিরবেন তো? যোধপুর পার্ক?
ওরে বাবা! শুধু নাম নয়, এ যে ধামও চিনে বসে আছে। বলেন, না, না, তুমি ব্যস্ত হয়ো না। অপেক্ষা করতে করতে নিশ্চয় পেয়ে যাব একসময়।
–বিলক্ষণ! তা আর বলতে! আর তর্কের খাতিরে ধরুন যদি না-ই পান, ক্ষতি কী? কাল সকালে তো আবার ফিরেফিত্তি এই আমড়াতলার মোড়েই আসতে হবে। ফার্স্ট পিরিয়ডেই ক্লাস। রাতটা কেটে গেলে সোজা ক্লাসে ঢুকে যাবেন। যাতায়াতের ট্যাক্সিফেয়ারটা বাঁচবে।
ওর চোখে-মুখে কথা বলার ধরনে হেসে ফেলেন প্রফেসর তালুকদার। বলেন, কোন ইয়ার?
ছেলেটি ট্যাক্সির সন্ধানে চলতে শুরু করেছিল। এ-কথায় থমকে থেমে পড়ে। ফিরে ঘনিয়ে আসে আবার। হেসে বলে, সে-কথা যে বলা বারণ, স্যার! আমি চেয়েছিলাম শুধু ‘পজেটিভ ক্যাটালিস্ট’-এর পার্টটুকু প্লে করতে। এনজাইমের মতো। আপনার সঙ্গে ট্যাক্সির সংযোগ ঘটিয়ে দিয়ে আমি থাকতে চেয়েছিলাম, ঐ যাকে বলে ‘আডিস্টার্বড ইন ম্যাস্ অ্যান্ড কেমিক্যাল কম্পোজিশান’।
রসায়নবিদ রসিক মানুষটি খুশি হলেন ওর বাকচাতুর্যে। প্রতিপ্রশ্ন করেন, আমি তোমার রোল-লাম্বারটা জেনে ফেললে তোমার ‘পজেটিভ ক্যাটালিস্ট’-এর ভূমিকাটুকু অব্যাহত থাকবে না?
ঘাড় চুলকে লাজুক লাজুক মুখে বললে, কেমন করে থাকবে স্যার? আমার ‘প্রক্সিলাভ’ বন্ধ হয়ে যাবে না?
উচ্চকণ্ঠে হেসে ওঠেন অধ্যাপক তালুকদার।
ঠিক তখনই একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায় রাস্তার ‘কার্ব’ ঘেঁষে।
ট্যাক্সিতে একজনমাত্র যাত্রী। নিঃসন্দেহে মুসলমান। দাড়ি, কাজ-করা সফেদ টুপি আর রসুনের গন্ধেই তা আন্দাজ করা যায়। মুখে বসন্তের দাগ। বছর সাতাশ-আঠাশ বয়স। ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিল। তালুকদার-সাহেব তার বয়সের অনুপাতে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন : যানা হ্যায়? যোধপুর পার্ক?
–ক্যেঁউ নেহি? উঠিয়ে…
অধ্যাপকমশাই পিছনের সীটে উঠে বসলেন। ড্রাইভার পুনরায় মিটার ডাউন করল। ছেলেটি রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল তখনো। হাত তুলে নমস্কার করল। প্রফেসর ওকে ইঙ্গিতে কাছে আসতে বললেন। ছেলেটি এগিয়ে এলে জনান্তিকে বললেন, কৃষ্ণা অনেকক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে!
ছেলেটি অবাক হল। ম্যাগাজিন-স্টলের কাছে থার্ড ইয়ারের কৃষ্ণা সেনকে অপেক্ষা করতে বলে ও যে এগিয়ে এসেছিল তা উনি জানলেন কেমন করে? ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল। কৃষ্ণা একমনে মাসিক পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছে। যেন এদিকে ওর নজরই নেই।
–আরও একটা কথা।
প্রফেসর তালুকদারের কণ্ঠস্বরে আবার এদিকে ফেরে। উনি বলেন, একটা কথা ভুলো না, ‘এনজাইম’! প্রক্সিতে ম্যাটিনী-শোর ফার্স্ট ক্লাস টিকিট পাওয়া সহজ, অনার্সের ফার্স্ট ক্লাস টিকিট নয় কিন্তু!
ছেলেটি সত্যিই লজ্জিত। বললে, আয়াম সরি, স্যার! দেবু রায়। ফোর্থ ইয়ার।
–কেমিস্ট্রি?
–না, স্যার। কেমিস্ট্রিতে অনার্স থাকলে কি আর চিনতে পারতেন না? ফিজিওলজি।
সর্দারজি তাগাদা দেয়, অব চলুঁ?
–চল।
অপরাহ্নের আলো কলকাতার সৌধশ্রেণীর মায়া কাটাতে পারছে না। রাস্তা ছায়া ছায়া। পথের বাঁ-দিকে সারি সারি বাড়ির মাথায়-মাথায় লেগে আছে সোনা-গলানো রোদের ছোপ–জলের ট্যাঙ্কিতে, চিলেকোঠায়, পারাবত-কূজিত কার্নিশে। নজর হল দেবু এগিয়ে এসে কৃষ্ণার কর্ণমূলে কিছু বলছে। কৃষ্ণা আড়চোখে অপসৃয়মাণ ট্যাক্সিটাকে দেখে নিয়ে জিব কাটল। থার্ড ইয়ারের কৃষ্ণা সেন ভেবেছিল ‘আর. কে. টি.’ ওকে দেখলেও চিনতে পারবেন না। কিন্তু প্রফেসর তালুকদারের স্মরণশক্তি অতি প্রখর। যে-কারণে জীবনে কখনো সেকেন্ড হতে পারেননি, বরাবর ফার্স্ট-ক্লাস ফার্স্ট! ঐ মেয়েটি একবার সোস্যালে গান গেয়েছিল। দুর্দান্ত গেয়েছিল–তখন তার নাম ঘোষিত হয়েছিল। উনি ভোলেননি।
হাতের ফোলিও ব্যাগটা পাশের সীটে রাখতে গেলেন। নজরে পড়ে, সেখানে ভাজকরা একখানা খবরের কাগজ। উর্দু দৈনিক। খুব সম্ভবত ঐ পূর্ববর্তী মুসলমান যাত্রীটি অনবধানে ফেলে গেছে। অথবা কৌতূহল অবসানের উচ্ছিষ্ট। বোধহয় ‘ইত্তেফাক’। কাগজটা সরিয়ে ফোলিও ব্যাগটা ওখানে রাখতে যাবেন ঠিক তখনই কাগজের তলা থেকে কী একটা মাসিক পত্রিকা পিছলে পড়ে গেল ট্যাক্সির চাতালে। অন্যমনস্কভাবে সেটা তুলে নিতে গিয়েই যেন একটা শক্ খেলেন। দ্রুতহস্তে পত্রিকাখানা চাপা দিলেন দৈনিকপত্রের নিচে। মনে মনে যেন বললেন : সরি।