–তুমি জান, ভারতবর্ষে আজ যারা ক্ষমতার চূড়ায় কাল তারা অপজিশন বেঞ্চে গিয়ে বসতে পারে। আজ যাদের প্রভাবে তুমি হাতে মাথা কাটছ তারাই তখন পথে পথে মিছিল করে ঘুরে মরতে পারে : আমাদের দাবী মানতে হবে। সেই দুর্দিনে ঐ টিপছাপ, ঐ রসিদ তোমার কাছে হাইড্রোজেন বোমারই সামিল! তাই না তোমার এত আপত্তি? কী? মাস্তান-সাহেব?
ওপক্ষ তবু জবাব দিল না।
–হ্যালো, মাস্তান? তুমি লাইনে আছ?
–আছি স্যার! আপনি একটি পাক্কা হারামজাদা ব্যক্তি আছেন! অলরাইট, ঐ শর্তেই আমি টাকাটা নেব।
–রসিদ দিয়ে? টিপছাপ দিয়ে?
–উপায় কি? টাকাটার বড় জরুরি দরকার। আই এগ্রি! কোনপক্ষই বোমা ফাটাতে পারবে না কোনদিনই। আজকে যারা পার্টি-ইন-পাওয়ার তারা অপজিশানে গেলেও আপনি ঐ রসিদটা দাখিল করতে পারবেন না। কারণ তাহলে ঐ ফটোগুলোও আমি দাখিল করব। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস যেদিকেই মোড় নিক আপনাকে ইজ্জত বাঁচাতে হবেই।
–তাহলে টিপছাপ দিয়ে টাকাটা নেবে?
–বলছি তো তাই নেব।
–কিন্তু ঐ মেয়েটারও টিপছাপ যে আমার চাই?
–দ্যাটস্ ইম্পসিবল। বিশ্বাস করুন, ও এখানে নেই।
–অলরাইট। কোথায় কীভাবে টাকাটা তোমাকে দেব তা এবার বল। সাতটা দিন সময় আমাকে দাও। টাকাটা জোগাড় করতে, আর দশ-বিশটাকার খুচরো নোটে তা ভাঙাতে। আজ রবিবার। আগামী রবিবার টাকাটা তোমাকে আমি দেব। বল, কখন কোথায়?
–রবিবার দেবেন? ওয়েল, তাহলে শনিবার বলব, এই সময়ই।
–আজ বলতে পার না?
–ছেলেমানুষী করবেন না, স্যার!
লাইন কেটে দিল লো্কটা।
০৯. একটা বিশ্রী দুর্ঘটনা
০৯.
সোমবার সকালে ঘটল একটা বিশ্রী দুর্ঘটনা।
কলেজ গেট-এর শ-দুই গজ দূর থেকেই গাড়ির গতি কমিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। সামনে কী একটা হৈ-চৈ বিক্ষোভ হচ্ছে। পথ-চলতি কে-একজন আগবাড়িয়ে বললে, ওদিকে যাবেন না দাদু, বোম্ ফাটছে।
কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে সেটা নতুন কিছু নয়। এ-পথে বৃষ্টির জলে যেমন জ্যাম হয়, বেহুদ্দো গাড়িতে-গাড়িতে জট পাকিয়ে যেমন জ্যাম হয়, তেমনি বোমা পড়ার কারণেও রাস্তা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যায়। মানুষজন তখন বড় রাস্তা এড়িয়ে গলি ঘুঁজি ধরে চলে। এদিক-সেদিক অসংখ্য গলিপথ।
কলেজ স্ট্রিট এই জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত।
তালুকদার লোকটির পরামর্শ মেনে নিলেন। গোলদিঘি পাক মেরে ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটুট ‘হল’ ঘুরে এসে পড়লেন বঙ্কিম চাটুজ্জে স্ট্রিটে। হিন্দু স্কুলের বিপরীতে ওঁর জানা এক প্রকাশকের দোকানের সামনে গাড়িটা পার্ক করে নেমে এলেন।
দোকানের মালিক ওঁকে আপ্যায়ন করে বসালো। উনি জানতে চাইলেন, কলেজের সামনে গণ্ডগোলটা কিসের?
প্রকাশক অমায়িক হেসে বললেন, আদার ব্যাপারি স্যার, জাহাজের খোঁজ রাখিনা। কিছু একটা ‘আমাদের দাবী’ নিশ্চয় আছে, যা বোধ করি কেউ মানছে না, তাই তার ‘কালো হাত ভেঙে দেওয়ার’, অথবা ‘গুঁড়িয়ে দেওয়ার’ আয়োজন। তবে এটুকু খবর পেয়েছি যে, পুলিসভ্যান এসে গেছে। একটু পরেই রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যাবে। ট্রামবাস চলবে আবার।
–কিন্তু আমার যে বারোটা দশে ক্লাস।
–ভুলে যান, স্যার। আপনি প্রেজেন্ট স্যার হলেও আপনার ছাত্রছাত্রীরা সবাই ‘অ্যাবসেন্ট স্যার’! কী খাবেন বলুন, গরম না ঠাণ্ডা?
–আরে না, না, আগে দেখে আসি ব্যাপারটা কী। শোন, আমার গাড়িটা রইল তোমার দোকানের সামনে। কেউ না চাকা খুলে নিয়ে যায়। একটু নজর রেখ।
–ঠিক আছে স্যার, যান। পুলিস ভ্যান এসেছে প্রায় ঘন্টাখানেক আগে। এতক্ষণে সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
গাড়িটা দোকানের সামনে লক করে পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলেন কলেজ গেট এর দিকে। এখনো সেখানে চাপ ভিড়। উত্তেজিত ছাত্রদের চিৎকার চেঁচামেচি, স্লোগান, কাউন্টার-স্লোগান। পুলিস ভ্যানের পাত্তা নেই। ট্রাম এখনো চালু হয়নি। গেটে ঢুকবার মুখে বাধা পেলেন। ভিড়ের ভিতর রাস্তা করে এগিয়ে যাওয়াই মুশকিল। হঠাৎ ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল একটি ছাত্র, ফোর্থ ইয়ার-এর তাপস মিত্র। ভিড় সরিয়ে রাস্তা করে দিয়ে বললে, আসুন, আসুন স্যার, গাড়ি কোথায় রাখলেন?
–হিন্দু স্কুলের সামনে। আজ আবার কী নিয়ে গণ্ডগোল?
–অনেক কাণ্ড হয়ে গেছে, স্যার। বলছি….না, না, ওদিকে যাবেন না। প্রিন্সিপাল-সাহেব ঘেরাও হয়ে আছেন। ওদিকে গেলে আপনিও ফেঁসে যাবেন। সোজা কেমিস্ট্রি ল্যাবে চলে যান।
–প্রিন্সিপ্যাল-সাহেব ঘেরাও হয়ে আছেন? কেন? কী ব্যাপার?
–তাহলে এদিকে সরে আসুন। একটু আড়ালে না হলে…
এত উত্তেজনাতেও ডেভিড হেয়ার নির্বিকার। বোমাই ফাটুক আর গুলিই ছুটুক জোব্বা গায়ে একইভাবে বই-বগলে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ বলে নয়। দশকের পর দশক। তাঁরই পায়ের কাছে সরে এলেন ওঁরা দুজন।
তাপস মিত্র ছাত্র য়ুনিয়ানের পাণ্ডা। তবে এবার ওদের পার্টি ইলেকশান জিততে পারেনি। বিধানসভার নজির দিয়ে বলা যায় তাপস এখন বিরোধী দলপতি। সে সংক্ষেপে যা জানালো তা এই রকম :
সকাল পৌনে-দশটায় কলেজের সামনে একটা দুঃসাহসিক ‘অ্যাবডাকশন-কেস’ হয়ে গেছে। কলেজের একটি ছাত্রী ট্রাম থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে কলেজে আসছিল, মাঝ-সড়কে তিন-চারজন গুণ্ডা তাকে চেপে ধরে। ওরা এসেছিল কালো রঙের একটা অ্যাম্বাসাডারে। সেটা রাস্তার ধারেই স্টার্টে রাখা ছিল, চালকের আসনে ড্রাইভার রেডি হয়ে বসে প্রতীক্ষা করছিল। মেয়েটি আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তিন-চারজন ষণ্ডা-মার্কার সঙ্গে সে পারবে কেন? প্রকাশ্য দিনের আলোয় কয়েক শ দর্শকের। চোখের সামনে ওরা জোর করে মেয়েটিকে গাড়িতে তুলে ফেলে। চার-পাঁচটি ছেলে ছুটে গিয়েছিল বাধা দিতে। তখন ওরা পরপর দুটো বোমা ফাটায়। তার সপ্লিন্টারে একজন আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আর একটি ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে গাড়ির উপর। গুণ্ডাদলের একজন ছেলেটির তলপেটে ছোরা বসিয়ে দেয়।