সেই ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ওরা কারবার ফেঁদে বসেছিল। হয়তো এতদিনে সোন্ধী আচমকা সপরিবারে ফিরে এসেছে। হয়তো বিগত সপ্তাহে সে পাঁচ সাতটা বিচিত্র টেলিফোন কল পেয়েছে। কেউ খুঁজছে সরযূকে, কেউ নমিতাকে, কেউ মালিনীকে। অথচ প্রত্যেকেই নিজ নিজ পরিচয় সযত্নে গোপন রাখতে চায়। নাম জানতে চাইলেই লাইন কেটে দিয়েছে। কেন? সোন্ধী সন্দিগ্ধ হয়েছে–খোঁজ নিতে গিয়ে প্রতিবেশীদের কাছে জেনেছে ‘কে বা কাহারা’ তার ফ্ল্যাটে বাস করে গেছে। পুরুষ এবং স্ত্রীলোক। প্রতিবেশীরা ধরে নিয়েছিল তাঁরা সোন্ধীর রিস্তেদার। হয়তো তাই মায়াজাল বিস্তার করে সোন্ধী জানবার চেষ্টা করেছিল প্রফেসর তালুকদারের পরিচয়। নিদেন তাঁর টেলিফোন নাম্বার। মাস্তান এ বিষয়ে কতটা কী জানে তা জানা নেই কিন্তু সোন্ধী যে সন্দিগ্ধ, অ্যাপার্টমেন্টটা হাতছাড়া হবার পরেই তা বুঝেছে। হয়তো আচমকা পালাতে গিয়ে ফ্রিজে ফেলে আসতে হয়েছে অর্ধসমাপ্ত বিয়ার অথবা জীন-এর বোতল!
‘ফিয়ার ইজ দ্য কী!’–আতঙ্কের বলটা উনি ও-কোর্টে ফিরিয়ে দিলেন।
রবিবার রাত সাড়ে-আটটায় টেলিফোন রিসিভারের পাশে চুপচাপ বসে ছিলেন। ওঁর টেবিলের উপর একটা ইংরেজি পেপারব্যাক গল্পের বই, পাতা খোলা অবস্থায় পড়ে আছে : ফ্রেডেরিক ফরসাইথ-এর ‘নো কামব্যাকস্’! একটা পাতাও পড়তে পারছেন না। আশা ছিল, আতঙ্কগ্রস্ত ব্ল্যাকমেলার একই সময়ে ফোন করবে। সে সময়ে অন্য কেউ ফোনটা তুলুক তা উনি চান না।
ঠিক তাই সাড়ে আটটায় বেজে উঠল টেলিফোনটা।
–তালুকদার স্পিকিং।
–আজ্ঞে হ্যাঁ, আমিই বলছি। আপনি অহেতুক দরাদরি করছেন, স্যার। আপনি আমাকে চেনেন না। এসব ব্যাপারে আমি অত্যন্ত নিষ্ঠুর, জানে মারা পড়বেন কিন্তু।
পরিষ্কার সহজ সরল বাঙলা উচ্চারণ। কাবুলিওয়ালার সেই ‘খোঁকী তোমি সসুরবাড়ি যাবিস্’-গোছের বিকৃতির চিহ্নমাত্র নেই।
তালুকদার বললেন, লুক হিয়ার, মাস্তান! আয়াম নট আফটার এনি বারগেন!…অর ডু য়ু স্টিল প্রিটেন্ড দ্যাট য়ু ডোন্ট ফলো মি?
–না স্যার! আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি।
–তাহলে? আমি তো একটা নয়া পয়সা কমাবার কথা বলিনি। পুরো পঁচিশ হাজারই দেব। সমস্তই দশ বা বিশ টাকার নোটে। বিনিময়ে আমার ঐ শর্তটা তোমাকে মানতে হবে।
–ঐ রসিদে সই দিয়ে ব্ল্যাকমেলিঙের টাকা নেওয়া?
–হ্যাঁ, কিন্তু শুধু সই নয়, বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলের টিপছাপ।
–আপনাকে একটা কথা বলব, বিশ্বাস করবেন স্যার?
–ইতস্তত করছ কেন?
–ঐ যে কাল আপনি বললেন, ‘তোমার মতো অনারেবল…’, কিন্তু এখন যেটা বলছি তা আপনি যাচাই করে জেনে নিতে পারেন…
–কী কথা?
–ঐ ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে আপনি কিসসু করতে পারবেন না। অ্যাসুমিং আমার ফিঙ্গার প্রিন্ট পুলিসের কাছে আছে, অ্যাসুমিং সেই টিপছাপের সঙ্গে সোন্ধীর বাড়িতে ওরা যে টিপছাপ পেয়েছে তা মিলে গেল। তাহলে কী হবে?
–তুমিই বল?
–মাকড় মারলে যা হয় : ধোকড়! খুঁটির জোরে ম্যাড়া লড়ে শোনিননি? কোন শালা পুলিসের বড়সাহেবের হিম্মৎ হবে না…
–তাহলে তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন?
–এটাই আপনার ভুল। ‘ভয়’ আমি আদৌ পাইনি। কিন্তু তাই বলে বেহুদ্দো পঁচিশ হাজার টাকা খোয়াতেও আমি রাজি নই।
–বুঝলাম! তা এতই যদি বেপরোয়া তাহলে টিপছাপ দিয়ে ব্ল্যাকমেলিঙের টাকা নিতেই বা তোমার আপত্তি কিসের?
–কিন্ত ঐ টিপছাপ নিয়ে আপনি কী করবেন? পুলিসে যাবেন? আপনার ছাত্র সেই দিল্লীতে-পোস্টেড কল্যাণ সেনগুপ্ত, আই. পি. এস.?
তালুকদার বুঝতে পারেন লোকটা কতদূর খবর রাখে।
বলেন, না, মাস্তান। আমি পুলিসে যাব না আদৌ। রসিদটা ব্যাঙ্ক ভল্টে রেখে দেব।
–বাট হোয়াই? কেন?
–দেখ মাস্তান, আমি খোলা কথার মানুষ। হ্যাঁ, ভুল আমি একটা করেছি। তোমরা আমাকে বোকা বানিয়েছ। আমার অবশ্য এখনো দৃঢ় বিশ্বাস–সেই মেয়েটি স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে কোনও তঞ্চকতা করেনি। কেন এমন অদ্ভুত ধারণা হয়েছে, ওয়েল, তা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। ইন ফ্যাক্ট, তুমি যে স্তরের মানুষ, তাতে তোমার পক্ষে ওসব বোঝা সম্ভবপরও নয়। বাদ দাও সেকথা! ‘অ্যাভেইলেবল ডাটা’ অনুসারে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, মেয়েটি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তোমাকে ব্ল্যাকমেলিঙের সুযোগ করে দিতে। স্বীকার করতেই হবে, তোমরা আমাকে বোকা বানিয়েছ। ওয়েল, তার মূল্য আমি দেব। কড়ায় গণ্ডায়। যা তুমি চেয়েছ-গোনাগুন্তি পঁচিশ হাজারই। কিন্তু দুবার নয়। একবার! আমার মৃত্যুবাণ যেমন তোমার কাছে থাকবে, তেমনি তোমার মৃতুবাণও থাকবে আমার কাছে। দু-পক্ষের আর্সেনেলে হাইড্রোজেন বোমা থাকলে, কোন পক্ষই সেটা ফাটাতে পারে না। ফলো?
–আজ্ঞে না। যতক্ষণ না আমি মেনে নিতে পারছি যে, ঐ টিপছাপ দেওয়া রসিদটা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে।
–তাহলে তা দিতেই বা তোমার এত আপত্তি কেন?
–যেহেতু এটা একটা অ্যাবসার্ড প্রপোজিশান! পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ কোনদিন রসিদ দিয়ে ব্ল্যাকমানি নেয়নি।
–তার কারণটা কী তা জান?
–না। আপনিই বলুন?
–অলরাইট! কারণটা আমিই বলছি। কেন তুমি ভয় পাচ্ছ টিপছাপ দিতে।
–ভয় আমি পাচ্ছি না।
–পাচ্ছ! আলবৎ পাচ্ছ! একশবার পাচ্ছ! কেন পাচ্ছ, তা তুমিও জান, আমিও জানি।
–কী,বলুন?