–তাই তো। আমার যতদূর মনে পড়ে ও ‘ইস্লিসিট কনেকশন’ শব্দটাই ব্যবহার করেছে।
–তাহলে পড়াশুনায় সে অষ্টরম্ভা নয়। কেমন? কী নাম বলেছে?
–বললে তো ‘মাস্তান’। আমার বিশ্বাস হয় না। বাবা-মা কোনো সদ্যোজাত সন্তানের নাম ‘মাস্তান’ রাখতে পারে?
–পারে, যদি ‘মাস্তানির’ সহজাত কবচ-কুন্ডল নিয়ে সে মাতৃগর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করে। যা হোক, তুমি চিন্তা কর না, আমি সলিলকে জিগ্যেস করে যথোচিত ব্যবস্থা করব।
.
সেদিন কলেজেও এক কাণ্ড হল।
প্রিন্সিপাল-সাহেব তাঁর চেম্বারে ওঁকে ডেকে পাঠালেন। কলেজ সংক্রান্ত এ-কথা সে-কথার আলাপ আলোচনা হল কিছুটা। ইউ. জি. সি-র গ্রান্ট, কেমিস্ট্রি ল্যাবের এক্সপ্যানশন ইত্যাদি। তারপর সৌজন্যবোধে মিসেস তালুকদারের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে কিছু তত্ত্বতলাশ নিলেন। অতঃপর তাঁর ঝুলি থেকে বার করলেন বেড়ালছানাটিকে : আপনাকে একটি ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করছি প্রফেসর তালুকদার, কিছু মনে করবেন না। ‘সলিল মিত্র’ নামে আপনার কোনো নিকট আত্মীয় আছে?
ক্ষুরধার বুদ্ধির মানুষটি তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলেন ব্যাপারটা। ওঁর মনে পড়ে যায় অ্যালিস্টার ম্যাকলিন-এর একটি ক্রাইম থ্রিলার-এর কথা : ‘ফিয়ার ইজ দ্য কী!’ ভয়! আতঙ্ক! তিল-তিল করে প্রয়োগ করতে হয়। মাস্তান নামে ঐ যে ছেলেটি ওঁর সঙ্গে দ্বৈরথ সমরে নেমেছে সে চায় চারিদিক থেকে ওঁকে ঘিরে ধরতে। প্রকারান্তরে সে বুঝিয়ে দিতে চায়–ওঁর আত্মীয়-স্বজন, ওঁর কর্মস্থলের উপরওয়ালার সব সন্ধান সে যোগাড় করেছে। চতুর্দিকেই সে বোমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সব বিস্ফোরকই এক সূত্রে আবদ্ধ। ওঁর প্রত্যাখ্যানমাত্র ‘ফিউজ’-এ অগ্নিসংযোগ করা হবে। মুহূর্তমধ্যে কলকাতা শহরের সবচেয়ে নামকরা কলেজের অতি সম্মানীয় কেমিস্ট্রির অধ্যাপক রঞ্জন তালুকদার পি. আর. এস. ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবেন! ‘ফিয়ার ইজ দ্য কী?’ তিনটি দিন সময় সে দিয়েছে ওঁকে। শুধু টাকা সংগ্রহের জন্য নয়, পঁচিশ হাজার টাকাকে ছোট ছোট ব্যবহৃত নোটে রূপান্তরিত করতেই শুধু নয়–ঐ বাহাত্তর ঘণ্টা ভয়ে একেবারে কাঁটা হয়ে থাকতে!
তালুকদার বললেন, আমার উপাধি শুনে ঠিক বোঝা যায় না স্যার যে, ‘তালুকদার’ একটা নবাবী খেতাব। আমার পূর্বপুরুষরা পেয়েছিলেন। বাস্তবে আমরা বারেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। ‘মিত্র’ কীভাবে আমার নিকট আত্মীয় হবে?
–না, মানে, আজকাল তো অসবর্ণ বিবাহ ঘরে-ঘরে। তাই বলছি। ব্যাপারটা কী জানেন?…
একই কাহিনী। অজ্ঞাতনামা একটি অবাঙালী লোক ভাঙা-ভাঙা বাংলায় প্রিন্সিপাল-সাহেবকে টেলিফোনে একটি অনুরোধ করেছে। তার অভিযোগ : প্রফেসর তালুকদারের এক নিকট আত্মীয় সলিল মিত্র আবেদনকারীর পিসতুতো ভগিনীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে। বিস্তারিত কিছু সে বলেনি। শুধু আর্জি পেশ করেছে যাতে প্রফেসর তালুকদার মধ্যস্থতা করে ঐ সলিল মিত্র আর তার ভগিনী মালিনীর ‘মানি-সেটলমেন্ট’ কেসটা তাড়াতাড়ি ফয়শালা করে দেন।
তালুকদার সরাসরি জানিয়ে দেন, আজ্ঞে না। লোকটা কোথাও কিছু ভুল করেছে। সলিল মিত্র নামে আমি কাউকে চিনি না।
০৮. নাছোড়বান্দা ছিনেজোঁক
০৮.
শনিবার সওয়া আটটা নাগাদ উনি ওঁর স্টাডি-রুমে এসে বসলেন। ঐ নাছোড়বান্দা ছিনেজোঁকটির সঙ্গে একাই মোকাবিলা করতে হবে। দ্বৈরথ সমরে। তার অসংখ্য গুণগ্রাহী ছাত্র, শিষ্য, পাঠক-পাঠিকা। কিন্তু কারও কাছে সাহায্য চাইবার কোনো উপায় নেই। একদিকে ঐ মাস্তান, উদ্ধত যুবক, তার সঙ্গীসাথী, তার আগ্নেয়াস্ত্র, ছুরি-ক্ষুর অ্যাসিড বাল্ব, পেটোয়া পুলিস, অন্য দিকে প্রৌঢ় একজন পণ্ডিত। ল্যাবরেটরি আর লাইব্রেরির চৌহদ্দিতে জীবনটা যিনি পাড়ি দিয়ে এসেছেন নির্বিবাদে। তাঁর হাতিয়ার তাঁর শিক্ষা, তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধি, অসাধারণ উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর সারাজীবনে হার-না-মানার স্ট্যামিনা! ভয় পেলে চলবে না, ভয় তিনি পাননি। দ্বৈরথ সমরে অবতীর্ণ হতে প্রস্তুত বৃদ্ধ মানুষটি।
স্টাডিরুম ভিতর থেকে বন্ধ। পাশের ঘরে ধর্মেন্দ্র না শশী কাপুর কে যেন ভিলেনকে ক্রমাগত টিশম্-টিশম্ কিলিয়ে চলেছে। টি. ভি.-তে। প্রফেসর তালুকদারও ঐভাবে মাস্তানকে ঠ্যাঙাতে পারেন, যদি ভিলেনের ঘুসিগুলো ওঁর হয়ে খায় ওঁর ডামি। না হলেও পারেন, যদি নেপথ্য নাট্যকারের তাই নির্দেশ থাকে। বৃদ্ধ বলে তিনি লড়তে ভয় পাবেন না। ও-ঘরে প্রণতি আর রামু সেই লড়াই দেখতে বুঁদ। ওরা জানে না, ঠিক পাশের ঘরে এই নিরস্ত্র বৃদ্ধ এক রিভলভারধারীর সঙ্গে একইভাবে মোকাবিলার তাল ভাঁজছেন। কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটায় রিঙিং টোন শুরু হতেই তুলে নিয়ে তার কথামুখে’ বললেন : তালুকদার।
–নমস্তে! রোপেয়ার ইন্তেজাম হইয়েসে স্যার?–কী বিনীত মোলায়েম কাকুতি!
–না!
–না! কেনো! তিন-সেট পিকচার আর নিগেটিভ আপনি খরিদ করবেন না?
–করব। কিন্তু…
–আ! সমঝলম! ভাও লিয়ে দরাদরি করবার হিঞ্ছা হইয়াসে?
–না! দরাদরি নয়। আমি জানতে চাইছি কেন তুমি প্রিন্সিপাল-সাহেবকে ফোন করেছিলে? জগদীশকে কেন বলেছ…
–আহাহা! দিমাগ খারাপ করছেন কেন প্রফেসর-সাব? আসল কথা তো কিছু বলি নাই প্রফেসর-স্যার? আমি কি ওঁদের বলেছি প্রফেসর তালুকদার-সাহাব এক ছুকরির সঙ্গে লেংটা-খেলা খেলিয়েসেন? আপন গড! সি-কথা কুছু বলি নাই। বেহুদ্দো দিমাগ কেনো খারাপ করছেন, স্যার? ছবি আর নেগেটিভ কিনে লিন, ব্যস্। লেঠা চুকিয়ে যাক। ই-সব নোংরা ঝামেলা হমার বুঢ়া লাগে।