অবশ্য সে কৃতিত্বের বৃকোদর-ভাগ সেই মেয়েটির প্রাপ্য! যাঁকে ওর মনে হয়েছিল শুধু রতিরঙ্গরসেই নয়, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, কৃষ্টিতে সে Phryne! অমন একটি মেয়েকে কী করে পার্টনার-ইন-ক্রাইম করতে সক্ষম হল এ লোকটা? তা সে যাই হোক, ও নিশ্চয় এতক্ষণ কোনো পাবলিক টেলিফোন-বুথ থেকে ওঁর সঙ্গে কথা বলেছে। জানে, পুলিস সেই উৎসমুখের সন্ধান পেলেও ওকে ধরা-ছোঁওয়ার মধ্যে পাবে না। তাতেই একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা চালাতে ও গররাজি।
পুলিসে খবর দেবার প্রশ্নই ওঠে না। কেউ ওঁকে ব্ল্যাকমেলিঙ করবার চেষ্টা করছে। এ-জাতীয় এজাহার দেবার সঙ্গে সঙ্গে জানাতে হবে–কী নিয়ে ‘ব্ল্যাকমেলিং’। এভিডেন্স হিসাবে ঐ ছয়খানি ছবি তাঁকে দাখিল করতে হবে। লোকটা ধরা পড়লে মামলা আদালতে উঠবে। আসামী পক্ষের উকিল ছবিগুলি প্রকাশ্য আদালতে…
নাঃ। সে অসম্ভব। বস্তুত এটাই হচ্ছে ‘ব্লাকমেলিং বিজনেসের’ বিউটি টাচ্! সারা বিশ্বে ব্ল্যাকমেলারদের হাতে অনিবার্যভাবে থাকে রঙের টেক্কাখানা। যতক্ষণ না সেটা টেবিলে নামানো হচ্ছে ততক্ষণ তাকে কেউ ছুঁতে পারে না। না ভিকটিম, না পুলিস। সম্মান বাঁচাতে গিয়ে, অপরাধটা গোপন করতে গিয়ে, কেলেঙ্কারিটা রুখতে গিয়ে মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। দশ-বিশ বছর আধপেটা খেয়ে, না-খেয়ে, হতভাগ্যের দল ব্ল্যাকমেলারকে টাকার যোগান দিয়ে চলে। উপায় নেই। ঐ রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের খপ্পরে একবার পড়লে আমৃত্যু নিষ্কৃতি নেই! এটাই এ খেলার একপেশে নিষ্ঠুর নিয়ম!
কিন্তু প্রফেসর রঞ্জন তালুকদার যে জীবনে কখনো কারও কাছে হার মানেননি। মর-মানুষের কাছে। প্রণতির দুর্ভাগ্যটা নিতান্ত নিয়তি। তবু সেবার মাথা খাড়া রেখেই ঈশ্বর-নিক্ষিপ্ত–ঈশ্বর বলে যদি আদৌ কোনো সত্তা থাকে–বজ্রটা বুক পেতে গ্রহণ করেছিলেন।
কিন্তু এবার?
.
রাত্রে আহারের অবকাশে তালুকদার জানতে চাইলেন আজ টি. ভি. তে ‘চিত্রহার’ ছিল না?
প্রণতি জানেন, এসব নিতান্ত ‘খেজুরে-আলাপ’। অধ্যাপক মশায়ের ওসবে আদৌ কোনো আকর্ষণ নেই। এ শুধু আলাপ-জমানোর অহৈতুকী প্রয়াস। বললেন, সেই অভদ্র লোকটা ফোন করেছিল? সাড়ে আটটায়?
–করেছিল! অভদ্র শুধু নয়, অসভ্য!
উনি মনগড়া এক দীর্ঘ কাহিনী শোনালেন। বিপদ কখন কীভাবে আসবে জানা নেই। লোকটা নানাভাবে ওঁর গৃহের শান্তি বিনষ্ট করবার চেষ্টা করতে পারে। ভয় দেখাতে। সেক্ষেত্রে প্রণতিকে একটু-একটু করে তৈরি করতে হবে। আসন্ন বিপদ সম্বন্ধে কিছুটা প্রস্তুতি থাকলে অজ্ঞাত আঘাতের আকস্মিকতার ধার কিছুটা ভোঁতা হয়ে যাবে। বড় জাতের শক ভাল নয় প্রণতির দুর্বল হৃদয়ের পক্ষে।
উনি যে গল্পটা ফাঁদলেন তাতে আছে এক ভিলেন। নানান পাপ কাজে সে হাত পাকিয়েছে। ওয়াগন ব্রেকার। ইলেকশনের সময় বুথ দখল করার বিনিময়ে রাজনৈতিক দলের প্রিয়পাত্র হয়ে পড়েছে। পুলিস তাকে ছুঁতে সাহস পায় না। ভয় পায়, তাহলে তাকে পাণ্ডববর্জিত স্টেশানে বদলি করে দেওয়া হবে। এ হেন মন্ত্রীমহলের প্রিয়পাত্র যে গুণ্ডা, তার একটি মাসতুত ভগিন আছে। চোরে-চোরে সম্পর্ক অথবা সত্যিই মাসির মেয়ে, জানা নেই, তবে মেয়েটি পড়াশুনায় ভাল। নাম মালিনী। এবার সে নাকি ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় পাস করেনি। ফেল করেছে তালুকদার-সাহেবের পেপারেই। তাই ঐ মস্তান ওঁকে টেলিফোনে শাসাচ্ছে। বলছে, মেয়েটাকে পাস করিয়ে না দিলে…
ভয়ে নীল হয়ে যান প্রণতি, তুমি…তুমি কী করবে?
–আরে, অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? এটা কলকাতা শহর!
–কলকাতা শহরে খুন-জখম হয় না? বিশেষ যদি প্রভাবশালী মন্ত্রী-টন্ত্রীর পোষা গুণ্ডা হয়?
–তুমি ভেব না। যা ব্যবস্থা নেবার আমি নেব। পুলিসের টপ-লিস্টে কল্যাণ আছে। কল্যাণ সেনগুপ্ত। তুমি তো চেনই। আমার প্রিয় ছাত্র। ওকে একটা ফোন করে দেব। ও মস্তান পার্টিকে কড়কে দেবে।
.
পরদিন এল জগদীশের ফোন : জামাইবাবু, তোমার সেই ছাত্রটি লোক সুবিধের নয় কিন্তু….
–কোন ছাত্রটি?
–ঐ যে সুবল মিত্তির না সলিল মিত্তির। ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে থাকে বলে যে তোমার অ্যাড্রেসটার সুযোগ নেয়।
–তাই নাকি? তুমি কী করে জানলে?
–কাল একটা মিস্টিরিয়াস টেলিফোন পেয়েছি। বুঝলে? প্রথমে আমার নামটা জেনে নিয়ে লোকটা জানতে চাইল তুমি আমার ভগিনীপতি কি না। স্বীকার করায় বললে, তোমার এক ছাত্র কিংবা ‘কোলীগ’ সলিল মিত্র একটা মেয়ের সঙ্গে লটঘট করছে। মানে, ‘ইল্লিসিট কানেকশন’। মেয়েটার নাম মালিনী। ওর মামাতো বোন। ও আমাকে বলেছে তোমাকে অনুরোধ করতে, যেন সলিল মিত্র মালিনীর সঙ্গে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেয়।
–‘ব্যাপারটা’ মানে?
–পরিষ্কার করে বলেনি। হয় ‘মানি-সেটলমেন্ট’ অথবা বিয়ে করা। ঠিক বোঝা গেল না।
–আই সী! কথা শুনে তোমার কি মনে হল ও লোকটা লেখাপড়া জানা বাঙালী…
–আদৌ নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও পশ্চিমা মুসলমান। লেখাপড়ায় অষ্টরম্ভা। ভাঙা-ভাঙা বাঙলা বলতে পারে মাত্র…
–বুঝলাম। তুমি আমাকে দুটো শব্দ শুনিয়ে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে। একটা ‘লটঘট’ একটা ‘ইল্লিসিট কনেকশন’। ও নিজে কোনটা ব্যবহার করেছিল, জগু? ঐ মিস্টিরিয়াস লোকটা?
–কেন বল তো, রঞ্জনদা?
–তোমার স্টেটমেন্ট অনুযায়ী লোকটা ভাঙা-ভাঙা বাংলা বলতে পারে। ফলে ‘লটঘট’ শব্দটা সে ব্যবহার করবে না। কথিত বাংলায় যার যথেষ্ট দখল তার পক্ষেই শব্দটা ব্যবহার্য। আবার পড়াশুনায় যে অষ্টরম্ভা তার পক্ষে ‘ইস্লিসিট কনেকশন’ শব্দের প্রয়োগ…