পরদিন কলেজ থেকে ফিরে এসে শুনলেন, সারা দিন কে-একটা বেগানা লোক ওঁকে বারে বারে ফোন করেছে। নামটা জানায়নি, কিন্তু রামুকে বলেছে–তার সাহেব ফিরে এলে যেন জানানো হয়, রাত সাড়ে আটটায় সে আবার ফোন করবে। ব্যাপারটা নাকি খুবই জরুরী। সাহেব যেন রাত সাড়ে আটটায় বাড়িতে থাকেন।
প্রণতি বিরক্ত হয়ে বলেন, কে বল তো লোকটা? কী চায়? ভারি উদ্ধত মেজাজের। অসভ্য।
বুঝলেন সবই। মুখে বলতে হল, আমি কী করে জানব?
কাঁটায়-কাঁটায় আটটা উনত্রিশে টেলিফোনটা বেজে উঠল।
উনি প্রস্তুত হয়ে বসেছিলেন। পড়ার টেবিলে। বাঁ-হাতটা টেলিফোন রিসিভারে রেখে। ঘর ভিতর থেকে অর্গলবদ্ধ। একবার মাত্র রিঙিং টোন হতেই তুলে নিয়ে গম্ভীরস্বরে বললেন, ইয়েস! তালুকদার বলছি…
–আপনি কি প্রফেসর রঞ্জন তালুকদার আছেন?
পুরুষকণ্ঠ। বিকৃত কণ্ঠস্বর। উচ্চারণও বিকৃত। পশ্চিমা ঢঙে। হয়তো ইচ্ছাকৃত।
উনি ওর খাজা বাঙলার জবাবে বললেন, আছি।
–অ! আছেন! বাই মিসটেক প্রফেসর সলিল মিত্র আছেন না তো?
দাঁতে-দাঁত চেপে নীরব রইলেন। বঁড়শিতে মাছটা নিশ্চিত গেঁথেছে বুঝতে পেরে ও লোকটা ওঁকে একটু খেলিয়ে তুলতে চায়।
–কী হল, প্রফেসর-সাহেব? গুম খেয়ে যাচ্ছেন কেন? সুতো ছাড়লুম, অখন ঘাই মারুন। আর কুছু না পারেন তো শালা-বাহানচোৎ করুন।
–কী চাও তুমি?
–আপনাকে এক সেট পেরিস্ পিকচার প্রেজেন্ট পাঠিয়েসি। পাইয়েসেন তো?
–কী নাম তোমার?
–প্রফেসর-সাহাব। আপনাকে একঠো প্রশ্ন করা হইয়েসে, জবাবটা পহিলে দিন! এতটা উমর হল, ই-কথা জানেন না কি, আসামী সির্ফ জবাব দিয়ে যায়, সওয়াল করে না? প্রফেসর তালুকদার, আপনি আপনার ল্যাংটো ছবি পাইয়েসেন?
উপায় নেই। সংক্ষেপে সারতে না পারলে ও ক্রমেই অশ্লীলতর আলাপচারি শুরু করবে। বললেন, পেয়েছি।
–বহুৎ সুক্রিয়া! অব শুনেন, স্যার। ছয়খানা ছবির তিন-তিন সেট প্রিন্ট করা হইয়েসে। একসেট আপনার প্রিন্সিপাল-সাহেবের খাতির, দুসরা-সেট মিসেস তালুকদারের খাতির। সমঝলেন? অখন থার্ড সেট কুথায় যাবে আন্জাদ করতে পারেন?…কোই বাত নেই, থিংক করেন…
প্রফেসার তালুকদার অসীম ধৈর্যে নীরব রইলেন। লোকটা ওঁকে ভয় দেখাতে চাইছে। ভয় যে পাননি তা নয়, কিন্তু ভয়ে বুদ্ধিভ্রংশ হতে দেবেন না কিছুতেই! হার মেনে নেওয়া ওঁর ধাতে নেই।
অবশ্য এমন নরকের কীটের সঙ্গে দ্বৈরথ সমরে নামবার দুর্ভাগ্য ওঁর আগে কখনো হয়নি জীবনে।
–টাইম খতম হইয়ে গেলো। আন্জাদ করতে সেকলেন না। আপনার কলেজে ঘুস্তে একঠো বড়কা লুটি বোর্ড আছে না? ঐ বোর্ড-এ ছয়খানি ফটো রাতারাতি লটকে দিয়ে আসব। প্রফেসররা সবাই দেখবে, ছেলেরা দেখবে, ঔর ছুকরিগুলান ভি দেখবে। এখন বলুন স্যার, এ বে-ইজ্জতি রুখতে চান? ইয়েস্ অর নো?
–কত টাকা চাইছ?
স্পষ্ট উচ্চারণে বললে, নাউ য়ু আর টকিং প্রফেসর! সিধা হিসাব! ইচ সেট ছবির দাম পাঁচ পাঁচ হাজার, ঔর নেগেটিভ দস হাজার। অব হিসাব জুড়িয়ে লিন : তে-পাঁচা পন্দের ঔর দস–পঁচিস হাজার! লেকিন সবটা দস-বিস টাকার য়ুজ্ট্ নোটে! সমঝলেন?
লোকটা নিজেকে অবাঙালি, অশিক্ষিত উত্তরভারতের লোক বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। বাস্তবে ও বাঙালী এবং শিক্ষিত। উনি টাকার অঙ্কটা জানতে চাওয়া মাত্র আনন্দে ওর ছদ্মবেশটা খণ্ডমুহূর্তের জন্য গা থেকে খুলে গেছিল। ‘আন্দাজ’কে যে ‘আন্জাদ’ উচ্চারণ করে সে হঠাৎ-খুশিতে ঐ ইংরেজি লব্জ্টা কিছুতেই বলতে পারে না ‘নাউ য়ু আর টকিং, প্রফেসর!’ ইংরেজিতে অনেক ক্রাইম থ্রিলার ওর পড়া।
–কী হল প্রফেসর-সাব? ফিন গুম খেয়ে গেলেন নাকি?
–অত টাকা আমি কোথায় পাব?
–ই একটা কোথা হল? রাজারা মানিক পায় কুথায়?
আবার–আবার একটা ক্লু। ‘কথা’ কে ‘কোথা’, ‘কোথায়’কে ‘কুথায়’ যার বাংলা জ্ঞান, তার সঞ্চয়ে থাকা সম্ভবপর নয় ঐ বাঙলা ঘরোয়া রসিকতা ‘রাজারা মানিক পায় কোথায়’? লোকটা এক নিশ্বাসে বলেই চলেছে, ক্যাশ-সার্টিফিটি তোড়াতে পারেন, ইউনিট-ট্রাস্ট, এন. এস. সি. নিদেন প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে লোন। ভাবীজীর দু-চারখান অর্নামেন্টস্ ঝেড়ে দিলেই বা কে ঠেকাচ্ছে? ভাবীজীর তো মালুম পড়বে না। ব্যাঙ্ক-ভল্ট তো আপনিই ট্রানস্যাক্ট করেন।
পাকা ক্রিমিনাল সন্দেহ নেই; কিন্তু সূক্ষ্ম কারিগরী এখনো আয়ত্ত করতে পারেনি। মিসেস্ তালুকদার যে পঙ্গু,এ সংবাদ পর্যন্ত সংগ্রহ করেছে অথচ বুঝতে পারে না যে, একটা অর্ধশিক্ষিত মানুষ, যে ‘সার্টিফিকেট’কে ‘সার্টিফিটি’ বলে, সে ‘ব্যাঙ্ক-ভল্ট ট্রানস্যাক্ট’ করার কথা বলতে পারে না! সে দিলখুশ হলে ফস্ করে বলে বসতে পারে না : নাউ য়ু আর টকিং, প্রফেসর!
কাঁচা কাজ!
–কী হল? কুছ তো বলেন?
বুঝতে পারেন, এর সঙ্গে দরদাম চলবে না।
বললেন, একটা শর্তে আমি টাকাটা দেব।
–কী শর্ত?
–টাকাটা আমি ঐ ঠিকানায় দেব। তোমার পার্টনার-ইন-ক্রাইম সেই মেয়েটির সামনে, সেই এইট বাই টোয়েন্টি…
–থামুন, থামুন! টেলিফোনে ই-সব বাৎ বোলতে নেই। সে অ্যাপার্টমেন্ট অখন বেহাৎ! তিন রোজ টাইম দিচ্ছি। আজ বুধবার আছে, শনিচর রাত সাড়ে-আট বাজে ফিন টেলিফোন করে জানাব কোথায়, কীভাবে প্যাকেটটা আপনি দিবেন। সমঝলেন?
–শোন…
ও-প্রান্তবাসী শুনল না। রিসিভারে ফোনটা নামিয়ে রাখল। সম্ভবত ওর একটা আশঙ্কা আছে পুলিস ওকে খুঁজছে। ও কোথা থেকে ফোন করছে তা ধরবার চেষ্টা করতে পারে পুলিস। দীর্ঘসময় টেলিফোন-লাইনে থাকলে ‘গোস্ট-কল’ খুঁজে বার করা যায়–এ তত্ত্বটা ওর জানা। যতই অশিক্ষিত বলে নিজেকে জাহির করতে চাক ও বেশ ভালই শিক্ষিত। ‘ব্ল্যাকমেলিং’ যদি একটি অপরা-বিদ্যা হয় তাহলে সে সে বিদ্যা ভালভাবেই আয়ত্তে এনেছে। শুধু আলাপচারিতায় অভ্যস্ত হয়নি। তাছাড়া ব্যবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি নেই। প্রফেসর তালুকদারের মতো মানুষকেও সে ফাঁদে ফেলতে পেরেছে।