দিন-সাতেক পরে সাহসে ভর করে ফোন করলেন ওকে। রামু তখন বাজারে। প্রণতি অঘোরে নিদ্রায় অভিভূত। বারদুয়েক রিঙিং টোনের পর ও-প্রান্তে সাড়া জাগল : ইয়েস, সোন্ধী স্পিকিং।
ইংরেজিতে বললেন, মালিনী আছে? একটু ডেকে দেবেন?
–হু?
–ডিয়ার মি! ওর নাম কি তাহলে মালিনী নয়? এটা এইট বাই টোয়েন্টি মেঘচুম্বিত অ্যাপার্টমেন্টস’ তো?
–দ্যাটস রাইট। কী নাম বললেন? মালিনী?
–নামটা ভুলও হতে পারে। আমি লিখে রাখিনি। বয়স প্রায় ত্রিশ।
–আ-ইয়েস! মালিনী। তাই বলুন। ও বাথরুমে আছে। একটু লাইনটা ধরুন। কী নাম বলব? কে নে করছেন?
–মিত্র, সলিল মিত্র।
ওঁর স্পষ্ট মনে হল টেলিফোনের ‘কথামুখে’ হাত-চাপা দিয়ে ও-প্রান্তবাসী ইংরেজিতে উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘মালিনী তোমাকে টেলিফোনে সাম মিস্টার মিত্র খুঁজছেন। তোমার কি বাথরুম থেকে বার হতে দেরি হবে?
তারপর একটু নীরবতা। বাথরুম থেকে কেউ কিছু বলল কি না বোঝা গেল না। অন্তত টেলিফোনে কোনো শব্দ ভেসে এল না। তারপর ভদ্রলোক টেলিফোনে বললেন, মালিনীর দেরী হবে বাথরুম থেকে বের হতে। ও রিং-ব্যাক করবে বলল! আপনার নম্বরটা কাইন্ডলি…
তালুকদার সর্তক হয়ে উঠেছেন ইতিমধ্যে।
বলেন, আমার বাড়িতে ফোন নেই। পোস্টঅফিস থেকে ফোন করছি।
–আই সি! ধরুন!
আবার ‘কথামুখে’ হাত চাপা দিয়ে ভদ্রলোক উচ্চকণ্ঠে কাকে যেন ইংরেজিতে বললেন, ওঁর ফোন নেই। কী বললে? অ্যাড্রেস? ও আচ্ছা…ঠিক আছে লিখে রাখছি…
এই কথাগুলি মাউথপিসে ফাঁকা-আঙুলে হাত চাপা দিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলা হল। তারপর ও-প্রান্তবাসী বেশ সহজকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, এক্সকিউজ মি, মিস্টার মিত্র, ও ‘সলিল মিত্রকে ঠিক প্লেস করতে পারছে না। আপনি কি বালিগঞ্জ থেকে বলছেন? আপনার অ্যাড্রেসটা কাইন্ডলি…।
অধ্যাপক তালুকদার নিঃশব্দে ধারক-অঙ্গে টেলিফোন যন্ত্রটা নামিয়ে রাখলেন। সাবধানী বুদ্ধিমান মানুষটির মনে হল সোন্ধী মায়াজাল বিস্তার করতে চাইছে। মালিনী মেয়েটির নাম নয়, হতে পারে না। কবি কালিদাসের প্রসঙ্গে কাব্য করে ও ছদ্মনাম নিয়েছিল : মালিনী। আর সেই জন্যই প্রথমবার ও-প্রান্তবাসী নাম শুনে চিনতে পারেনি। প্রতিপ্রশ্ন করেছিল : হু?
খুব সম্ভবত সোন্ধীর বাথরুমে কেউ ছিল না।
সে শূন্যে কথাগুলি ছেড়ে দিয়ে ওঁর বিশ্বাস উৎপাদনের চেষ্টা করছিল। কায়দা করে ওঁর টেলিফোন নাম্বার অথবা ঠিকানাটা জানতে চাইছিল।
উপায় নেই। মেয়েটি নিজ থেকে যোগাযোগ না করলে এ রহস্যজাল ছিন্ন করা যাবে না।
কিন্তু ওঁর গরজটাই বা কী? একটা দুঃস্বপ্ন–আচ্ছা, না হয় ‘সুখস্বপ্নই’ হল—‘স্বপ্ন’ বলে অভিজ্ঞতাটাকে গ্রহণ করলে ক্ষতি কার?
০৭. একটা মোটা খাম
০৭.
আরও দিন-তিনেক পরে ডাকবাক্স থেকে উদ্ধার করলেন একটা মোটা খাম। সলিল মিত্রের নামে। বেশ ভারী খাম। বাড়তি ডাকটিকিট দিতে হয়েছে। ও বোধহয় অনেক কিছু লিখেছে। স্টাডিরুমে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে সযত্নে পেন-নাইফ দিয়ে খামটা খুলে ফেললেন।
ভিতর থেকে বার হয়ে এল খান-ছয়েক পোস্টকার্ড-সাইজ রঙিন হট-শট ফটোগ্রাফ।
বজ্রাহত হয়ে গেলেন অধ্যাপক তালুকদার!
ঐ ছয়খানি রঙিন আলোকচিত্র ব্যতিরেকে লেফাফার ভিতর আর কিছু ছিল না। প্রতিটিই চূড়ান্ত পর্নোগ্রাফিক আলোকচিত্র। নরনারীর নিরাবরণ যৌনমিলনের দৃশ্য। তিনখানি ছবিতে পুরুষটির পিছন দিক দেখা যাচ্ছে, সে তিনটিতে মালিনীকে চিনতে কোন অসুবিধা হয় না। দু-খানি ছবিতে অধ্যাপক তালুকদারের সম্মুখদৃশ্য। চশমাটা খোলা আছে, তবু চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না, সে তিনটিতে রতিরঙ্গসঙ্গিনীর পশ্চাদ্দেশ দেখা যাচ্ছে। বাকি একখানি পাশ থেকে তোলা। প্রোফাইল। নায়ক নায়িকা দু-জনকেই স্পষ্ট সনাক্ত করা যায়।
যা ছিল মধুর স্বপ্নময় আধোস্মরণে তা পুরীষক্লিন্নকদর্যতায় উপস্থিত হল চাক্ষুষভাবে। ভয় তো পেয়েছেন বটেই, ঐ সঙ্গে নিদারুণ একটা বেদনার অনুভব!
মেয়েটি এই! মানুষ চিনতে পারলেন না। সে তো একটা পয়সাও হাত পেতে নেয়নি। বলেছিল, তার দক্ষিণা ওঁর তৃপ্তির পরিমাণ-নির্ভর। পরে, হ্যাঁ শেষ পর্যায়ে যা বলেছিল তা অন্য দৃষ্টিভঙ্গির। ফ্রিনে তার নারীত্বের মর্যাদা দাবী করেছিল প্র্যাক্সিটেলেস্-এর কাছে। তাকে উপেক্ষা করে উনি ফিরে এলে নাকি ফ্রিনের শাশ্বত নারীত্বের অপমান! কী সব বড় বড় কথা!
বাস্তবে–ছি, ছি, ছি! ভারী পর্দার পেছনে হটশট ক্যামেরা হাতে প্রতীক্ষায় ছিল ওর পাপের সঙ্গী। তাই ঘরে অত জোরালো আলোর আয়োজন। হয়তো ফ্লাশবালবে ঝিলিকও দিয়েছে–তখন নেশাগ্রস্ত প্রৌঢ় মানুষটি ছিলেন দীর্ঘ তিন দশকের তৃষ্ণায় কাতর। জৈবক্ষুধায় হতভাগ্য তখন তুরীয়ানন্দে অন্য জগতে। এসব জাগতিক কাণ্ডকারখানার ঊর্ধ্বে, বহু ঊর্ধ্বে।
ছি-ছি-ছি! এ কী হয়ে গেল!
জীবনে যিনি কখনো হার মানেননি–স্কুল-কলেজ জীবনে কখনো সেকেন্ড হননি, তিনি এভাবে চূড়ান্তভাবে হেরে গেলেন একটা বেশ্যা আর তার নাগরের ছলনায়! জীবনে এত বড় সমস্যার সম্মুখীন হননি কখনো। প্রণতির অ্যাকসিডেন্টের সময়েও এতটা বিচলিত হয়ে পড়েননি। সেবার মাথা খাড়া রেখেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অফারটা ফেরত দিয়েছিলেন। কিন্তু এবার? ওরা তো অনতিবিলম্বেই ব্ল্যাকমেলিং শুরু করে দেবে!