ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, কিন্তু কেন? পাপ-পুণ্য মান বলে?
–না, আম্রপালী–আমি বৈজ্ঞানিক! পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক আমাদের মানতে নেই!
–আর ঈশ্বর?
–ঈশ্বর ওয়াজ আউট অব বাউন্ডস্ ঈভন টু দ্য লর্ড বুদ্ধা, জীবকমাতা!
–তাহলে কেন? কেন এই তিন দশকের ব্রহ্মচর্য? পার্সোনাল এথিক্স?
মাথা ঝাঁকি দিয়ে প্রৌঢ় মানুষটি বলে ওঠেন, আমার কথা থাক আম্রপালী। আমি জানতে এসেছি তোমার কথা। সেই কথা বল। লুক হিয়ার! আমি মহামানব তথাগত নই। জনপদবধূ আম্রপালীকে রাতারাতি বৌদ্ধ ভিক্ষুণীতে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা আমার নেই। বাট…বা…আমি সাহিত্যিক…আমি কথাশিল্পী…আমি কবি। সমাজের কাছে আমি দায়বদ্ধ…’দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর, তার পরে ছুটি নিব’! এই কণ্টাকাকীর্ণ সমাজে ঐটুকুই আমার দায়িত্ব। শুধু দু-একটি কাঁটা…আই মাস্ট নো, কেন তোমার মতো একটি রমণীরত্ন….
মেয়েটি কী একটা কথা বলতে চায়। উনি হাত বাড়িয়ে তার মুখটা চাপা দিলেন। বলেন, আমার বলা শেষ হয়নি আম্রপালী! আমি যেমন গৌতম বুদ্ধও নই, তেমনি ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষিও নই। ঠিক জানি না, হয়তো আত্মপ্রতারণা! হয়তো শুধু সত্যের সন্ধানে নয়, সৌন্দর্যের সন্ধানেই আমি ছুটে এসেছিলাম–ঠিক যেমন করে দু’হাজার বছর আগে প্র্যাক্সিটেলেস ছুটে যেতেন ফ্রিনের কাছে…
বাহুবন্ধন মুক্ত করে নিজে থেকেই সরে যায় মেয়েটি।
বলে, ‘ফ্রিনে’ কে, আমি জানি না।
–‘প্র্যাক্সিটেলেস’কে জান?-
-না! কোনো গ্রীক দার্শনিক?
–না! দার্শনিক নন। সমকালের তো বটেই, বোধকরি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর। ‘ভেনাস ডি মিলো’ হয়তো তাঁরই কীর্তি। তিনি ভালবেসেছিলেন ফ্রিনেকে। ফ্রিনে, এথেন্সের সর্বশ্রেষ্ঠা সুন্দরী হেটেরা, জনপদকল্যাণী! অনাবৃতা ফ্রিনেকে মডেল করে একাধিক ভেনাস মূর্তি গড়েছিলেন প্র্যাক্সিটেলেস। তার একটির পাদমূলে আজও খোদাই করা আছে গ্রীক ভাষায় শিল্পীর স্বীকৃতি, যার ইংরাজী অনুবাদ “Praxiteles hath portrayed to perfection the Passion (Eros), drawing his model from the depths of his own heart and dedicated Me to Phryne, as price of Me”
–ইংরেজিতে বলছ কেন? আর কী বিদঘুঁটে ইংরেজি!
–হ্যাঁ, তার কারণ গ্রীকভাষা থেকে অনুবাদক আক্ষরিক অনুবাদ করেছিলেন। তাও দু-তিনশ বছর আগে। চসার আর শেক্সপীয়ারের অন্তর্বর্তীকালে। আমি নিজেই একটা বাংলা অনুবাদের চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু নিজেই তার অর্থ বুঝিনি।
মালিনী হাসল।
বলল, শুনি তোমার অনুবাদ?
“–অ্যাক্সিটেলেস তাঁর অন্তরের অন্তস্তল থেকে (দেহজ) কামনার অনিন্দিত ব্যঞ্জনাটি এখানে মূর্ত করেছেন, আর সেজন্যই আমাকে উৎসর্গ করে গেছেন ফ্রিনের উদ্দেশ্যে–সেইতো আমার মূল্য।”
–কিন্তু তা কি সম্ভব? প্র্যাক্সিটেলেস কি ‘ভেনাস’-এর সত্য-শিব-সৌন্দর্যের নাগাল পেয়েছিলেন ফিনেকে অস্বীকার করে? অপমান করে?
–অপমান করে?
–নয়? তুমি আমার নারীত্বকে অস্বীকার করছ, অপমান করছ! তোমায় হৃদয় দিয়ে নয়, মানিব্যাগ থেকে আমার সম্মানমূল্য মেটাতে চাইছ? এভাবে তো হয় না প্র্যাক্সিটেলেস! Pay the price of Phryne! ফ্রিনের নারীত্বের মর্যাদা যে তোমাকে সর্বাগ্রে মিটিয়ে দিতে হবে। অর্থ দিয়ে নয়, সর্বাঙ্গ দিয়ে।
ধীরে ধীরে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন প্রৌঢ় অধ্যাপক তালুকদার।
বললেন, আয়াম সরি।
দুটি হাত বাড়িয়ে দিলেন সামনের দিকে। সবলে বুকে টেনে নিলেন ওকে।
০৬. আরও সাতটা দিন
০৬.
আরও সাতটা দিন কেটে গেছে। তারপর।
আবছা মনে পড়ে অভিজ্ঞতাটা। ঘোর-ঘোর বিস্মৃতির একটা কুয়াশা জড়ানো। এল. এস. ডি, বা মারিজুয়ানা সেবনের স্বর্গসুখস্মৃতি যেন! মনে পড়ে, আচমকা ডোর-বেলটা আর্তনাদ করে উঠেছিল। তখন ওঁরা দুজনেই আদম-ঈভ! ঘরে সর্বক্ষণ একটা জোরালো বাতি জ্বলছিল। এত প্রখর আলো ওঁর ভাল লাগছিল না। মেয়েটি শোনেনি। বলেছিল, ‘আমরা কি চুরি করছি’? ডোর-বেলটা আচমকা বেজে উঠতেই মেয়েটি হাত বাড়িয়ে চট করে নিবিয়ে দিল বাতিটা। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, পালাও। ও এসে গেছে!
–ও? ও কে?
–ডোন্ট আস্ক কোশ্চেনস্। নাও, পরে নাও।
অন্ধকারে ওঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল ড্রয়ার, গেঞ্জি, প্যান্ট, শার্ট!
আবছা অন্ধকারে খানিকটা নিজে নিজে পরলেন, খানিকটা ও পরিয়ে দিল। ‘জিন’-এর প্রভাব ততক্ষণে জম-জমাট!
–এস, আমার সঙ্গে এস। কোথায়, তা জানতে চাননি। বেডরুমের সংলগ্ন টয়লেটে একটা ছোট একপাল্লার দরজা। বাইরের করিডোর থেকে জমাদারের আসার পথ। সেই দরজাটা খুলে ও বলল, বাঁ দিকে লিফট।
–আর তুমি?
–আমার জন্যে ভাবতে হবে না। আই নো হ্যোয়ার আই স্ট্যান্ড!
তা বটে! এটা ফ্রিনের নিজস্ব সাম্রাজ্য!
কিন্তু ‘ও’ কে? সোন্ধী? তার সঙ্গে তো ওর ডির্ভোস হয়ে গেছে। ও তো নিজেই বলেছে, ও মিসেস সোন্ধী নয়!
ঠিক তখনই লিটা এসে দাঁড়ালো আট নম্বর ফ্লোরে। স্বয়ংক্রিয় লিফটে দ্বিতীয় যাত্রী ছিল না। ফলে কেউ জানতে পারল না, ওঁর জামার বোতামগুলো ভুল ঘরে লাগানো।
অ্যাপার্টমেন্টের সামনেই দাঁড়িয়েছিল একটা ট্যাক্সি। সৌভাগ্যই বলতে হবে। তখন ওঁর শারীরিক অবস্থা খুব জুতের নয়। যোধপুর পার্কে নিজস্ব বাড়ির নম্বরটা তা বলে ভুলে যাননি। ট্যাক্সি থেকে নেমে মানিব্যাগ খুলে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে দিয়েছিলেন সে কথা মনে আছে। কিন্তু লোকটা ভাঙানি ফেরত দিয়েছিল কিনা সেটা মনে পড়ে না।