–জানি। কেভ সিক্সটিন। সব গাইড বইতে যাকে ভুল করে লেখে ‘দ্য ডাইং প্রিন্সেস’। মেয়েটি রাজনন্দিনী আদৌ নয়। আমারই মতো জনপদকল্যাণী।
রীতিমতো অবাক হলেন অধ্যাপক তালুকদার। মেয়েটির পড়াশুনার রেঞ্জটা জানা নেই। কিন্তু ও সেই জাতের উত্তরাধিকার বহন করছে, প্রাচীন গ্রীসে যাদের বলত ‘হেটেরা’, প্রাচীন ভারতে ‘রাজনৰ্তকী’।
আর এক সিপ পান করলেন। জিন আগে কখনও পান করেননি।
স্বাদটা ভালই লাগছে। একটু কড়া! বোধহয় এক গ্লাসে ডবল-পেগ দিয়েছে।
দুজনেই নিঃশব্দে পান করতে থাকেন।
তারপর মালিনী বললে, এবার তোমাকে তোমারই অস্ত্রে বধ করব অধ্যাপক। বল তো, বৌদ্ধযুগে একজন অযোনিসম্ভবা জনপদকল্যাণী সে-কালীন শ্রেষ্ঠ ভেষগাচার্যকে গর্ভে ধারণ করে….
তালুকদার ওকে কথাটা শেষ করতে দিলেন না। তাঁর বাঁহাতে ধরা ছিল পানপাত্রটা, ডান হাত বাড়িয়ে চেপে ধরলেন ওর গজদন্তশুভ্র বাহুমূল। উত্তেজিতভাবে। বলে ওঠেন, তুমিও কি তা পার না কল্যাণী? সেই অযোনিসম্ভবা জীবমাতা আম্রপালীর মতো? এই তিনশ বছরের বুড়ি কলকাতা-শহরের ট্রামরাস্তার উপর দাঁড়িয়ে সমকালকে ফুকারে উড়িয়ে দিয়ে শাশ্বত আম্রপালীর মতো উদাত্ত নির্ভীককণ্ঠে ঘোষণা করতে : প্রভু বুদ্ধ লাগি, আমি ভিক্ষা মাগি…..
মেয়েটি হঠাৎ ম্লান হয়ে গেল।
ওর চোখজোড়া আর্দ্র হয়ে উঠল। যে-হাত ওর বাহুমূল ধরে আছে তার উপর একটি হাত আলতো করে চাপা দিয়ে বললে, আমার গর্ভেও এসেছিল জীবক! জানলে? কিন্তু কী করব? তথাগত তো কোনদিনই এসে পদধূলি দিলেন না এই আম্রপালীর সর্বতোভদ্রে! তেমন করে কেউ যে আমার কানে কানে বীজমন্ত্রটা…
ঘরের টেবিল-ল্যাম্পটা বার-দুই দপ্ করে জ্বলে কী-যেন ইঙ্গিত করে নিভল।
তালুকদার বলেন, লোডশেডিং হল নাকি?
মেয়েটি ভ্রূক্ষেপ করল না। বলে, একটা কথার সত্যি জবাব দেবে, অধ্যাপক?
বেশ নেশা হয়েছে। ঘরটা দুলছে।
তালুকদার বললেন, কী জানতে চাও? জিজ্ঞেস করে দেখ…..
গ্লাসের তলানিটুকুও গলায় ঢেলে দিলেন।
মালিনী উঠে গেল বেডরুম-এ। শূন্য পান-পাত্র দুটি নিয়ে।
ফিরে এল একটু পরেই। পূর্ণপাত্র হাতে। নির্দ্বিধায় একটি পাত্র গ্রহণ করলেন তালুকদার। ওঁর মনে পড়ল না, কোথায় বসে আছেন, মনে পড়ল না বাড়ি ফেরার কথা, অথবা ‘অ্যালকোহল’-এর প্রতিক্রিয়া আগে কখনো উপভোগ করেননি। আবার এক চুমুক পান করে বললেন, কী জানতে চাইছিলে, আম্রপালী?
–তুমি লিখেছিলে যে, তুমি বিবাহিত। মিসেস মিত্র কি জানেন যে, তুমি আম্রপালীর প্রমোদভবনে আজ এসেছ স্পর্শ-বাঁচানো পূজা সংখ্যার প্লটের সন্ধানে?
একটু থমকে গেলেন উনি। প্রণতির প্রসঙ্গ উঠে পড়তে পারে এটা বোধহয় আন্দাজ করেননি। একটু গম্ভীর স্বরে বললেন, না! সে হতভাগিনী কিছুই জানে না। আর, স্পর্শ তো বাঁচেনি, আমি তোমার বাহুমূল চেপে ধরেছি কামোন্মত্ত না হলেও উত্তেজিত হয়ে…
–আমি তো তোমার ঠিকানা জানিই। আমি যদি গিয়ে তাঁকে বলে আসি?
ধীরে ধীরে মেয়েটির বাহুমূল ছেড়ে দিলেন। শয্যালীন একটি প্রৌঢ়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওঁর। বললেন, খুব সম্ভবত তুমি তাঁর বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারবে না। এ তাঁর চিন্তার বাইরে। দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ বছরের দাম্পত্যজীবন আমাদের। কিন্তু যদি কোনভাবে তুমি অকাট্য প্রমাণ দাখিল করতে পার, তাহলে সে মর্মান্তিক আহত হবে। হয়তো মরে যাবে! ইয়েস! মরেই যাবে!
খিলখিল করে হেসে ওঠে প্রগলভা রূপোপজীবিনী। ওরও বেশ নেশা হয়েছে এতক্ষণে।
বলে, মরে যাবে? অ্যাকেরে মরে যাবে? হিংসেয়? বুক ফেটে? যাঃ!
সোজা হয়ে বসলেন প্রফেসর তালুকদার।
পানপাত্রটা নামিয়ে রাখলেন টুলে।
এই প্রথম বিচলিতবোধ করলেন উনি। মনে হল, কাজটা ঠিক হয়নি, ঠিক হচ্ছে না! এ জাতীয় আলোচনা উঠে পড়তে পারে, তা আন্দাজ করেননি।
গম্ভীর হয়ে বললেন, হ্যাঁ, তাই! কথাটার ঠিক বাংলা নেই, তাই তোমার কাছে ‘রিডিক্লাস’ মনে হচ্ছে! কিন্তু লিটারালি ‘বুক ফেটে’ই মরে যাবে সে! আসলে ওর হার্ট খুব দুর্বল। প্রেশার খুব হাই! ও…ও একজন ‘ইনভ্যালিড’… ক্রিপড! চিররুগ্না। বাথরুমে পর্যন্ত যেতে পারে না। আমি পাঁজা-কোলা করে নিয়ে যাই…
বেদনার্দ্র হয়ে উঠল প্রগলভার মুখ।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। জানতে চাইল, কতদিন? কতদিন উনি শয্যাশায়ী?
তালুকদার ওর চোখে-চোখে তাকিয়ে বললেন, এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমার ভাগ্যের অদ্ভুত মিল!
–মানে?
–আমার বিবাহিত জীবনও—’বায়োলজিকাল’ অর্থে বলছি–এক বছর। তারপর একটা অ্যাকসিডেন্টে…
তার মানে বলতে চান বিশ-পঁচিশ বছর ধরে আপনি…
–আঠাশ বছর। কিন্তু হঠাৎ ‘আপনি’ কেন? ট্রিলজি লিখবে নাকি?
ধীরে ধীরে আবার বসে পড়ে।
এবার চেয়ারে নয়। ওঁর সামনে, মেঝেতে। দু-হাতে ওঁর হাটু-জোড়া জড়িয়ে ধরে বলে, আয়াম সরি! রিয়েলি সরি!
–য়ু নিড্ন্ট বি! তোমার দুঃখিত হবার কী আছে?
–ওঁর অসুস্থতা নিয়ে আমি রসিকতা করেছি, ব্যঙ্গ করেছি—
–কিন্তু তখন তো তুমি সব কথা জানতে না।
ওঁর কোলে মাথাটা রাখল। বন্ধনীমুক্ত হৃদয়োচ্ছ্বাসের যুগল পেলব স্পর্শ অনুভব করলেন জানুতে। সংযতস্বরে বললেন, চেয়ারে উঠে বস, আম্রপালী!
–বসছি। তার আগে একটা কথা বলুন…আপনি কি, মানে এই দীর্ঘ আটাশ বছর ধরে…
–হ্যাঁ, তাই! বেণীর সঙ্গে মাথা দিতে চেয়েছিলে তুমি; আমি প্রত্যাখ্যান করেছি, কিন্তু জিন-উইথ-লাইমের মতো সে ‘আনন্দ’ অনাস্বাদিতপূর্ব নয় আমার কাছে! আঠাশ বছর আগে…