- বইয়ের নামঃ আম্রপালী
- লেখকের নামঃ নারায়ণ সান্যাল
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. বিচিত্র পত্রিকা
আম্রপালী – নারায়ণ সান্যাল
রচনাকাল : জুলাই-আগস্ট ১৯৯১
প্রথম প্রকাশ : বইমেলা মাঘ ১৩৯৮, জানুয়ারি ১৯৯২
প্রচ্ছদ : সুধীর মৈত্র
অলংকরণ : লেখক
প্রুফ-নিরীক্ষা : সুবাস মৈত্র
প্রকাশক : সুধাংশুশেখর দে, দে’জ পাবলিশিং
উৎসর্গ
‘সুন্দরম’ নাট্যগোষ্ঠীর কুশীলবদম্পত্তি
শ্রীমতী শর্মিলা মৈত্র
শ্রীদীপ্তেন্দ্রকুমার মৈত্র
যুগলকরকমলেষু
.
কৈফিয়ৎ
ফ্রেডেরিক ফোরসাইথ –সেই যে লেখকের The Day of the Jackal এক সময় রাতের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিল–তাঁরই লেখা একটা ছোটগল্পের সংকলন হাতে এল : No Comebacks। দশটি অনবদ্য ছোটগল্প। পর পর দুটিকে ‘ঝিন্দের কারাগারে’ বন্দী করে ফেললাম। একটি : ‘Money with Menaces’ হয়ে গেল ‘আম্রপালী’, অপরটি, ‘Privilege’, একই সঙ্গে প্রকাশিত হচ্ছে : ‘মান মানে কচু’।
পাণ্ডুলিপি অবস্থায় মুষ্টিমেয় যে-কজন ‘আম্রপালী’ পড়েছেন তাঁদের একজনের প্রশ্নে রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছি। উনি বললেন, “খোলাখুলি বলুন তো দাদা, আপনি কী? দক্ষিণপন্থী না বামপন্থী? দিল্লীতে শান্তি বিঘ্নিত করে যে পথ-নটুয়া মারাত্মক বিদ্রোহের বাণী প্রচার করছিল, মনে হচ্ছে আপনি তার প্রতি সহানুভূতিশীল; আবার এদিকে বানতলার হাটে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভেও আপনার প্রতিবাদ? তাহলে আপনি কোন দলে?”
আমার মনে যে প্রশ্নটা জেগেছিল তা আর জানতে চাইনি : “আপনি নিজে কোন দলে? মাফিয়া?”
জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভোটদাতাদের পোলারাইজেশন দিন-দিন জোরদার হয়ে উঠছে। সর্বত্র। ভৌগোলিক এলাকা নিয়ে, ব্যবসায়ের চৌহদ্দি নিয়ে, ফুটপাথের দখল, হকারস্টল, খেলা, শিক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনাকে দল বেছে নিতে হবে– হয় ডান, অথবা বাম। সেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সংক্রামিত হয়েছে বুদ্ধিজীবীদের পরিমণ্ডলেও। প্রাবন্ধিকেরা তো বটেই, কথাসাহিত্যিক, এমনকি কবির দল, ইদানীং হয় উত্তর-মেরুতে, নয় দক্ষিণ-মেরুতে। শুধু মস্তিষ্ক বা লেখনী নয়, পদচালনাও এখন ঐ ছন্দে বাঁধা। কেউ এ-দলের শোভাযাত্রায় পদযাত্রা করছেন, কেউ ও-দলের প্রতিবাদ-মিছিলে।
রাজনৈতিক দাদাগিরির তোয়াক্কা না রেখে ‘ভালকে ভাল’ আর ‘মন্দকে মন্দ’ বলার হিম্মৎই যদি না রইল তবে কিসের এই সাহিত্যসেবার ভড়ং? কথাসাহিত্যিক শুধুমাত্র সত্য শিব-সুন্দরের পক্ষাবলম্বন করতে পারবে না? বিশেষ সেই অন্তেবাসী কথাসাহিত্যিকের যদি পাঠক-পাঠিকার ভালবাসা ব্যতিরেকে আর কোনও পার্থিব কামনা-বাসনা না থাকে?
আর একজন জানতে চেয়েছিলেন : ভাগলপুর জেলের ভিতর কয়েকজন নিষ্ঠুর পুলিস যেভাবে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল, যেভাবে বিচারাধীন আসামীদের অন্ধ করে দিয়েছিল সেটাকে কি আপনি সমর্থন করেন?
জবাবে বলেছিলাম, আমার দায়িত্ব গল্প বলার। আমি নীতিবাগীশ প্রবন্ধকার নই। তা ভাল কথা, আমার গল্পের নায়ক যেভাবে সমাধানে পৌঁচেছিল আপনি কি সেটাকে পাঠক হিসাবে সমর্থন করেন না?
উনি এককথায় বলেন, এককথায় এর জবাব হয় না।
আমি বলি, তাহলেই আমি খুশি। ভাবুন, আরও ভাবুন! কল্পনায় অনুরূপ অবস্থায় নিজেকে স্থাপন করে ওর চেয়ে ভাল সমাধান খুঁজে পেলে আমাকে জানাবেন। আমিই না হয় আমার নায়কের মতো যথাযযাগ্য সম্মানমূল্যে প্লটটা আপনার কাছ থেকে কিনে নেব। আর একটা গপ্পো ফাঁদব।
নারায়ণ সান্যাল
নভেম্বর, ১৯৯১
.
০১.
ট্যাক্সির সিটে সেদিন যদি ঐ বিচিত্র পত্রিকাখানা আবিষ্কার না করতেন, তাহলে ওঁর জীবনে এ দুর্ঘটনা আদৌ ঘটত না। সেক্ষেত্রে চরিত্রবান বিজ্ঞানসাধকের মাথায় এতবড় কলঙ্কের বোঝাটা চাপত না। আর আমাকেও এই ‘অশ্লীল’ গল্পটা লেখার যন্ত্রণা ভোগ করতে হত না। কিংবা ধরা যাক, সেদিন সকালে ওঁর গাড়িতে যদি স্টার্টিং-ট্রাবল না দেখা দিত, নিজের গাড়ি নিয়ে নিত্যদিনের মতো যদি কলেজে আসতেন, তাহলেও কি এই অঘটনটা ঘটত? আদৌ না!
তো বাস্তবে সেসব যে ঘটেনি। সকালে গাড়িটা কিছুতেই স্টার্ট নিল না। গ্যারেজ আর গাড়ির চাবির থোকা ছট্টুলালের হাতে ধরিয়ে দিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে কলেজে চলে এসেছেন। যোধপুর পার্ক থেকে কলেজ স্ট্রিটে। ছট্টুলাল চেনা লোক, ওঁর বাড়ির সামনে তার রিপেয়ার গ্যারেজ। সারাদিনে সে গাড়িটা সারিয়ে রাখবে।
আসলে ঘটনাটা তো কলেজে আসবার সময় ঘটেনি, সেটা ঘটল ফেরার পথে। নিতান্ত আকস্মিকভাবে। অন্তত সে সময় তাই মনে হয়েছিল। একটা কাকতালীয় যোগাযোগ–কার্যকারণসম্পর্ক-বিরহিত।
কলেজ থেকে যখন বের হলেন তখনো সন্ধ্যা নামেনি, কিন্তু অফিসফেরত যাত্রীর ভিড়ে বাসের পাদানি উপচীয়মান। প্রফেসর রঞ্জন তালুকদারের বয়স হয়েছে। শিক্ষাবিভাগ না হলে এতদিনে পেনসন-ফাইল তৈরিতে মন দিতে হত। সরকারি চাকুরি থেকে রিটায়ারমেন্টের অনেক বাকি, কিন্তু মনুর বিধান মেনে পঞ্চাশোর্ধ্বের পূর্বেই বানপ্রস্থ নিয়েছেন। মানসিকভাবে। তা কেন? শারীরিকভাবেও। বন কি এই কলকাতা-শহর চৌহদ্দির বাইরে? বন এখন ঘরে ঘরে, বন এখন মন-এ মন-এ। এমনিতে শরীরে জরার আক্রমণ অনুভব করেন না। নিত্যপ্রাতে যোগাভ্যাস করেন। ইদানীং। আগে সকালে জগিঙে যেতেন। পাশের বাড়ির সমবয়সী পরেশবাবুর সঙ্গে। পরেশবাবু মারা যাবার পর জগিঙটা বন্ধ হয়েছে। তবু শরীর অটুট। এখনও সকালে আর সন্ধ্যায়–দিনে দুবার–প্রণতিকে পাঁজাকোলা করে বাথরুমে নিয়ে যেতে পারেন। যানও। হুইলচেয়ারটা বাথরুম-দরজার চেয়ে মাপে বড়। প্রণতি অবশ্য কঙ্কালসার–দশ বছর শয্যাশায়ী–কতই বা ওজন ওর? আর্থারাইটিস ছাড়াও নানান স্ত্রীরোগে একনাগাড়ে ভুগেই চলেছে।