সতনারান হালুয়াইয়ের ঘর বন্দরের বাইরে। আলু বেরিয়ে পড়ল রামদুলারির সন্ধানে।
সতনারানের অবস্থা খারাপ, কিন্তু এত যে খারাপ আলু তা জানত না। ভাঙা খোছড়া ঘর দাঁড়িয়ে আছে অসহায়ভাবে, নদীর বাতাসে তার চালটা কাঁপছে ঠকঠক করে। বারান্দায় একটা ভাঙা খাঁটিয়া, তার উপরে আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদছে সতনারান হালুয়াইয়ের বউ।
রামদুলারি কাঁহা? রামদুলারি?
সতনারানের বউ আরও তারস্বরে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। নামজাদা গুণ্ডা আলু খলিফার বুক কাঁপতে লাগল। জীবনে এই প্রথম ভয় পেয়েছে, এই প্রথম আশঙ্কায় তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে।
কী হয়েছে? কোথায় রামদুলারি?
রামদুলারি নেই। হ্যাঁ সত্যিই সে মরে গেছে। ভারী অসুখ হয়েছিল, কিন্তু এক ফোঁটা দাওয়াই জোটেনি। মরবার আগে চেঁচিয়েছে ভাত ভাত করে। গলা বসে গেছে, কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে দুটো মুমূর্ষু চোখ। চি চি করে আর্তনাদ করেছে ভাতের জন্যে, কিন্তু ভাত জোটেনি। কোথায় ভাত? রামদুলারি মরে গেছে। তার মুখে আগুন চুইয়ে শীর্ণ দেহটাকে নদীর জলে গাংসই করে দিয়ে এসেছে বাপ সতনারান।
টলতে টলতে চলে এল আলু খলিফা। সে খুন করবে, বহুদিন পরে খুন করবার প্রেরণায় তার শিরা-স্নায়ুগুলো ঝর ঝর করে উঠেছে। খুন করবে তাকেই—যে রামদুলারিকে মেরে ফেলেছে, শুষে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে সেই অদৃশ্য শত্রুকে, যার অলক্ষ মৃত্যুবাণ অব্যর্থ লক্ষ্যে হত্যা করে চলেছে? কোথায় সেই প্রতিদ্বন্দ্বী? ভোজালির সীমানার। মধ্যে তাকে পাওয়া যায় কী করে?
জগদীশের দোকান। আলুর মুখ দেখে জগদীশ চমকে গেল।
কী হয়েছে খলিফা?
আলু সেকথার জবাব দিলে না। শুধু বললে, একটা বোতল।
এই অসময়ে!
আলু চেঁচিয়ে উঠল কদর্য একটা গাল দিয়ে, তাতে তোমার কী?
জগদীশ আর কথা বাড়াল। নিঃশব্দে বোতল খুলে দিলে আলুর দিকে। কী যেন হয়েছে লোকটার। এমন মুখ, এমন চোখ সে আর কখনো দেখেনি, যেন থমথম করছে ঝড়ের আকাশ।
এক বোতল, দু-বোতল। আলু কাঁদতে জানে না, তার চোখের জল আগুন হয়ে ঝরে পড়তে লাগল। খুন করবে, খুন করবে সে। কিন্তু কোথায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী, তার শত্রু।
গা টলছে, মাথা ঘুরছে। বহুদিন পরে আজ আবার নেশা হয়েছে আলুর। এমনই নেশা হয়েছিল সেদিন, যেদিন গ্রেট মোগলাই হোটেলের ম্যানেজারের বুকে সে তার ছোরাখানা বিঁধিয়ে দিয়েছিল। হঠাৎ কী মনে হল—আরক্ত আচ্ছন্ন চোখ মেলে সে জগদীশকে লক্ষ করতে লাগল। একে দিয়েই আরম্ভ করবে না কি? জগদীশের পেটে বাঁটসুদ্ধ বসিয়ে দিয়ে প্রথম শান দেবে ভোজালিতে?
আলু চিন্তা করতে লাগল।
কিন্তু নিছক পিতৃপুরুষের পুণ্যেই এ যাত্রা জগদীশের ফাঁড়া কেটে গেল। গ্লেজ-কিড জুতো মচমচিয়ে ঘরে ঢুকল বনশিধর।
উল্লসিত কণ্ঠে বনশিধর বললে, কী খবর খলিফা, এই সাতসকালেই মদ গিলতে বসেছ?
আলু বললে, আমার মর্জি।
একটা বড়ো কনসাইনমেন্টের টাকা হাতে এসে পৌঁচেছে—অত্যন্ত প্রসন্ন আছে বনশিধরের মন। তাহলে এসো এসো, আরও চালানো যাক।
জগদীশ বললে, দু-বোতল গিলেছে কিন্তু।
আলু গর্জে উঠল, দশ বোতল গিলব, তোমার মুভুসুদ্ধ গিলব আমি।
দশ বোতল কেন, ভাঁটিটাই গিলে ফ্যালো-না। কিন্তু দোহাই বাবু, আমার মুন্ডুটাকে রেয়াত কোরো দয়া করে। জগদীশ রসিকতার চেষ্টা করলে একটা।
বনশিধর হেসে উঠল কিন্তু আলু হাসল না। চোখের জল আগুন হয়ে ঝরে যাচ্ছে! কে মেরে ফেলেছে রামদুলারিকে? কে কেড়ে নিয়েছে তার রোগের দাওয়াই, তার মুখের ভাত? কোথায় সেই শত্রুর সন্ধান মিলবে?
বোতলের পর বোতল চলতে লাগল! শরীরে আর রক্ত নেই, বয়ে যাচ্ছে যেন তরল একটা অগ্নি-নিঃস্রাব। বনশিধরের কাঁধে ভর দিয়ে জীবনে এই সর্বপ্রথম আলু মদের দোকান থেকে বেরিয়ে এল। এই প্রথম এমন নেশা হয়েছে তার। এই প্রথম তার পরের ওপরে নির্ভর করতে হয়েছে।
চলতে চলতে আলু জড়ানো গলায় বললে, বলতে পার দোস্ত, চাল গেল কোথায়?
চাল? বনশিধরের নেশাচ্ছন্ন চোখ দুটো পিটপিট করতে লাগল। অর্ধচেতন এই মানসিক অবস্থায় আলু অনেকখানি বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে তার কাছে। একটা বিচিত্র রহস্য উৎঘাটন করতে যাচ্ছে এমনই ফিসফিস করে চাপা গলায় বনশিধর বললে, দেখবে কোথায় চাল?
দেখব। প্রতিটি রোমকূপে অগ্নিস্রাব যেন লক্ষ লক্ষ শিখা মেলে দিয়েছে। দেখব আমি।
বনশিধরের অন্ধকার গুদামের ভেতর থেকে একটা তীব্র আর্তনাদ। লোকজন ছুটে এল ঊর্ধ্বশ্বাসে, দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। পাকার চালের বস্তার উপরে চিত হয়ে পড়ে আছে বনশিধর, রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক, আর তারই হাঁটুর ওপরে বসে ভোজালি দিয়ে নিপুণ কসাইয়ের মতো আলু খলিফা তার পেটটাকে ফালা ফালা করে কাটছে-বনশিধরের মেটে
বার করবে সে। মানুষ আর খাসির মধ্যে কোনো তফাত নেই, কাটতে একইরকম লাগে।
এতদিন ঘাতকের মতো মানুষের প্রাণ নিয়েছে আলু খলিফা, কিন্তু কেউ তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু যেদিন সে খুনের প্রথম অধিকার পেল, সেদিনই সে ধরা পড়ল পুলিশের হাতে।
আলুকাবলি
সকালবেলায় বেড়াতে বেরিয়ে প্রোফেসার গড়গড়ি দেখতে পেলেন, সামনের ছোট মাঠটার ভেতরে দুটি ছেলে মারামারি করছে।
দুজনকেই স্কুলের ছাত্র বলে মনে হল। চৌদ্দ-পনেরো বছরের মতো বয়েস হবে। একটি বেশ গাঁট্টাগোট্টা জোয়ান, আর একটি রোগাপটকা। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, রোগা ছেলেটিই মার খাচ্ছিল, জোয়ানটি তাকে ইচ্ছামতন পিটিয়ে যাচ্ছিল।