মায়া বসে গেছে এখানে, মায়া বসে গেছে এখানকার স্বল্পাবর্তিত সংকীর্ণ জীবনের ওপরে। স্বপ্নের মধ্যে সহস্র গলার আল্লা-হো-আকবর আর রক্তকে ফেনিল করে তোলে না, রামদুলারির মিষ্টি হাসি আর কচি মুখখানা ভেসে বেড়ায় চোখের সামনে। বয়স বেড়েছে আলু খলিফার। নিত্যসঙ্গী ভোজালির চওড়া ফলাটা ক্ষয়ে এসেছে আর তেমনি করে দিনের পর দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে মনের সেই পাশবিক উগ্রতা, সেই আদিম হিংস্রতার খর-নখরগুলো।
দিন কাটছিল, কিন্তু আর কাটতে চায় না। বাংলা দেশে মন্বন্তর এল।
পূর্বদিগন্ত থেকে, পশ্চিমের রণাঙ্গন থেকে কার একখানা আকাশজোড়া মহাকায় থাবা বাংলা দেশের ওপরে এসে পড়ল। নেই-নেই-নেই! তারপরে কিছুই নেই। তারও পরে দেখা গেল শুধু একটা জিনিস মাত্র অবশিষ্ট আছে, সে মৃত্যু। প্রতীকারহীন, উপায়হীন তিল তিল মৃত্যু।
প্রথম প্রথম সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করত আলু খলিফা, দেশের এ কী হল ভাই?
সংক্ষিপ্ত উত্তর আসত, যুদ্ধ।
যুদ্ধ-জং। কিন্তু জং তো আজকের দিনের ব্যাপার নয়, তারই দুই ছেলে তো জঙ্গি হয়ে জার্মান ঘায়েল করতে গেছে। এতদিন এই সর্বাঙ্গীণ অভাব কোথায় লুকিয়েছিল। তা ছাড়া ছোটোখাটো যুদ্ধ সেও না-করেছে এমন নয়। সেইসব দাঙ্গা, লাঠির শব্দ, মশালের আলো যুদ্ধ ছাড়া আর কী হতে পারে? কিন্তু এমন সর্বব্যাপী অভাবের মূর্তি তো চোখে পড়েনি কখনো।
খাসির দর বাড়ল, মাংসের দর বাড়ল। একপোয়া-আধপোয়ার খদ্দেররা আর এ পথ মাড়ায় না। দলে দলে দেহাতি লোক বন্দরে আসে, ভিক্ষা চায়, কাঁদে, হাটখোলার পাশে পাশে পড়ে মরে যায়। দিনের বেলাতেই শেয়াল-কুকুরে মড়া খায় এখানে-ওখানে। যুদ্ধ।
নেই নেই, কিছুই নেই। সাধারণ মানুষ যেন মৃত্যুর সঙ্গে মুহূর্তে মুহূর্তে লড়াই করে দিন গুজরান করে। এ এক আচ্ছা তামাশা, এও এক জং। আলু খলিফার বুকের রক্ত চনচন করে ওঠে উত্তেজনায়। প্রতিপক্ষকে যেখানে চোখে পায় না অথচ যার অলক্ষ্য মৃত্যুবাণ অব্যর্থভাবে হত্যা করে চলেছে—তাকে হাতের কাছে পাওয়ার জন্যে একটা হিংস্র কামনা অনুভব করে আলু।
একপোয়া-আধপোয়ার খদ্দের নেই, কিন্তু দু-সের আধ সেরের খদ্দের বেড়েছে। একটার জায়গায় দুটো খাসি জবাই করতে হয়, হাটবারে চারটে। আলু একা মানুষ, অভাববোধ তার কম তবুও অভাব এসে দেখা দিয়েছে। দামি মাংসের দামি খদ্দের বেড়েছে, জগদীশের দোকানে সন্ধ্যায় আর বসবার জায়গা পাওয়া যায় না। বনশিধর টাটকা সিল্কের পাঞ্জাবি পরে, দোক্তা-দেওয়া পান চিবোয়; মদের জন্যে নির্বিকার মুখে নোটের পর নোট বার করে। সমস্ত জিনিসটা গোলকধাঁধা বলে মনে হয় যেন। এত টাকা বেড়েছে বনশিধরের, টাকা বেড়েছে। হনুমান প্রসাদের, টাকা বেড়েছে আড়তদার গোলাম আলির, কিন্তু এত মানুষ না খেয়ে মরে যায় কেন?
দাঙ্গায় মানুষ মারতে ভালো লাগে—যে-মানুষের রক্ত উদবেলিত, হৃৎপিন্ড উত্তেজনায় বিস্ফারিত। কিন্তু যাদের অস্থির দেহ টুকরো টুকরো করে কাটলেও একবিন্দু ফিকে জোলো রক্ত বেরিয়ে আসবে না, তাদের এই মৃত্যু দুঃসহ বলে মনে হয়। আলু খলিফার অস্বস্তি লাগে।
বনশিধর আজকাল বিষয়কর্মে মন দিয়েছে। প্রায়ই বাইরে থাকে। শহরে যায়, ইষ্টিশনে যায়, আরও কোথায় ছুটে বেড়ায়। তারপর একদিন দেখা দেয় অতিশয় প্রসন্নমুখে। গায়ে পাটভাঙা সিল্কের পাঞ্জাবি, পায়ে গ্লেজ-কিডের জুতো, মুখে সুর্তি-দেওয়া পান আর সিগারেট। মদের দোকানে খুলে দেয় সদাব্রত।
তারপরে, তামাম চিজ পাচ্ছ তো খলিফা?
কই আর পাচ্ছি। বোকার মতো মুখ করে তাকায় আলু খলিফা। বড়ো বড়ো দুটো আলুর মতো আরক্তিম চোখ মেলে তাকিয়েই থাকে বনশিধরের পানের-কষ-রাঙানো পুরু পুরু ঠোঁটের দিকে। ভাই, এ কী হল বাংলা মুলুকের হালচাল!
পুরোনো প্রশ্নের পুরোনো জবাব সংক্ষেপেই দেয় বনশিধর, লড়াই।
লড়াই! কিন্তু তোমরা এত টাকা পাচ্ছ কোথা থেকে?
খোদা মান? যাকে দেয় ছল্পর ছুঁড়ে দেয়।
তা বটে।
কিন্তু খোদা মানলেও কার্যকারণ সম্বন্ধ তো একটা থাকা দরকার। লখনউ শহরের এক্সটার্নড গুণ্ডা অনেক বুঝতে পারে, কিন্তু এই সোজা কথাটা বুঝতে পারে না কিছুতেই। জীবনের গতি তার প্রত্যক্ষ আর সরল। বাহুবলে, অস্ত্রবলে উপভোগ করো সমস্ত। কেড়ে নাও, রাহাজানি করো, মানুষ মারো। কিন্তু রাহাজানি নেই, হাঙ্গামা নেই, অথচ টাকা আসছে আর মানুষ মরছে। হ্যাঁ, একেই বলে তকদির। খোদা দেনেওয়ালাই বটে।
ছিন্নকণ্ঠ খাসির রক্তে দোকানের সামনে মাটিটা শক্ত কালো পাথরের মতো চাপ বেঁধে গেছে। কিন্তু এত মানুষ যে শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে মরে গেল, তাদের রক্ত জমল কোথায়? এই হাজার হাজার মানুষের রক্তে সমুদ্র তরঙ্গিত হয়ে উঠেছে কোনখানে?
তারপর একদিন আলু খলিফার খেয়াল হল আজ অনেক দিন রামদুলারি তার দোকানে আসেনি। চাচাজির কাছ থেকে মেটে চেয়ে নিয়ে যায়নি কলাপাতার ঠোঙায়। কী হল রামদুলারির?
মনে পড়ল শেষ যেদিন এসেছিল সেদিন মেটে চায়নি, চেয়েছিল আধ সের চাল। চাচাজি, কাল সারাদিন আমাদের খাওয়া হয়নি।
বারো আনা দিয়ে আলু চাল কিনে দিয়েছিল রামদুলারিকে। কিন্তু পরদিন থেকে আর আসেনি রামদুলারি। নানা বিড়ম্বনা, বন্দরের পথে-ঘাটে মড়া, সন্ধ্যায় জগদীশের দোকানে বনশিধরের টাকায় মদের অবাধ স্রোত—কালো মেয়েটার কথা ভুলেই গিয়েছিল একেবারে। কিন্তু সকালে দোকানের ঝাঁপ খুলতে গিয়ে সমস্ত মনটা খারাপ হয়ে গেল।