কত করে সের? ও খলিফা?
বারো আনা।
বারো আনা? এ যে দিনে ডাকাতি?
ডাকাতি! আলু খলিফা হাসে। ডাকাতির কী জানে এরা, বোঝেই-বা কতটুকু। করকরে খানিকটা প্রবল হাসিতে মুখরিত করে দেয় চারদিক।
সেরা খাসি বাবু, থকথকে তেল। কলকাতা লখনউ হলে সের হত আড়াই টাকা।
নানা জাতের খদ্দের আসে। হিন্দুস্থানি নিরামিষাশী ব্যাবসাদারেরা লোক পাঠিয়ে গোপনে মাংস কেনে। কাঁধে কাছিম ঝুলিয়ে, বাঁশের দোলায় শুয়োর নিয়ে হাট-ফিরতি ওরাওঁ, তুড়ি কিংবা সাঁওতালেরাও এক-আধ সের মাংস নিয়ে যায়। ভোজালির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত মাংসকাটা কাঠটার নীচে জমে ওঠে রক্তমাখা সিকি-আধুলি, এক টাকার নোট। বারোটার মধ্যেই বিক্রিবাটা শেষ হয়ে যায় আলু খলিফার।
সন্ধ্যায় জগদীশের দোকান। এক বোতল তিরিশের মদ, ছিলিম তিনেক গাঁজা। জগদীশের সঙ্গে আলুর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব আজকাল। এরকম শাঁসালো খরিদ্দার দুর্লভ। বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ মাঝে মাঝে আলু জগদীশকে মাংস খাওয়ায়।
রাত ঘন হয়ে আসে। গ্রাম বন্দরের দোকানগুলো একটার পর একটা ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়। মদের দোকান থেকে ফিরে আসে আলু। কোনোদিন খাওয়া হয়, কোনোদিন হয় না। রক্ত আর ক্লেদের ওপরে স্যাঁতসেঁতে চট বিছিয়ে আলু তার উপরে এলিয়ে পড়ে। বাসি মাংসের গন্ধ ঘরময় ভেসে বেড়ায়, হাওয়াতে দড়িবাঁধা খাসির শেষাংশটুকু ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো এদিকে-ওদিকে দুলতে থাকে। নদীতে হিন্দুস্থানি মাল্লাদের ঢোলের শব্দ আর উদ্দাম চিৎকার শান্ত হয়ে আসে। শুধু বালুচরে থেকে থেকে গাংশালিক কেঁদে ওঠে টি-টি-ট্টি-টি— হট ট্রি-ডি-টি—
আলু খলিফা স্বপ্ন দেখে লখনউ শহরের। দাঙ্গা বেঁধেছে। আল্লা-হো-আকবর। লাঠির ঠকাঠক শব্দ, মানুষের চিৎকার, লেলিহান আগুন। হাতের ভোজালি বাগিয়ে ধরে ভিড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল রক্তলোলুপ বন্যজন্তুর মতো। বিদ্যুতের মতো ঝলকে উঠল ভোজালি। খাসির গলা নয়—মানুষের বুক। ফিনকি দিয়ে রক্ত এসে আলুর দুখানা হাতকে রাঙিয়ে দিয়েছে।
জগদীশ ছাড়া আরও দুটি বন্ধু জুটেছে আলু খলিফার। একটি ছোটো মেয়ে—রামদুলারি তার নাম। তার বাপ বাজারে কী-এক হালুয়াই দোকানের কারিগর। মাংস কিনতে আসে না, মাংস কিনবার পয়সা নেই। মাঝে মাঝে দূরে দাঁড়িয়ে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায়।
স্নেহ-ভালোবাসা বলে কোনো জিনিস নেই আলুর জীবনে। তবু সেই মেয়েটাকে তার ভালো লাগল। বছর পাঁচ-ছয় বয়েস, একমাথা ঝাঁকড়া চুল। কালো রঙের ওপরে সুঠাম মুখশ্রী। গলায় কাচের মালা। হাটের শেষে একটা কেরোসিনের টেরি জ্বালিয়ে রাত করে পয়সা খুঁজে বেড়ায়। কী পায় কে জানে, কিন্তু সাধনার বিরাম নেই।
আলুই নিজে থেকে যেচে আলাপ করে নিয়েছে ওর সঙ্গে। প্রথম প্রথম কাছে আসতে চায়নি, রক্ত-মাংসের মাঝখানে ওই অস্ত্রধারী ভয়ংকর মানুষটাকে দেখে ছুটে পালিয়ে গেছে।
আস্তে আস্তে তারপরে সহজ হয়ে এসেছে সমস্ত।
সকালে ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে দেখা দেয় ধূলিমলিন রামদুলারি।
আজকে ক-টা বকরি বানালে চাচাজি?
দুনিয়ার তামাম মানুষ বকরি হয়ে গেছে বেটি, তাই বকরি আর বানাই না। তাহলে তো দেশভর লোককে জবাই করতে হয়। তাই খাসি কেটেছি।
রামদুলারি কথাটা বুঝতে পারে না। বড়ো বড়ো বিস্ফারিত চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে চাচাজির মুখের দিকে। বলে, দুনিয়ার সব লোক বকরি?
বকরি বই কী। কিন্তু সে থাক। মাটিয়া লিবি বেটি? এই নে ভালো মাটিয়া রেখেছি তোর জন্যে। একপোয়া-আধপোয়া মেটে প্রকান্ড মুঠিতে যা ওঠে, কলাপাতার ঠোঙায় করে রামদুলারির হাতে তুলে দেয় আলু খলিফা। ভালো লাগে রামদুলারিকে, ভালো লাগে এই দাক্ষিণ্যটুকু। বাংলা দেশের মাটিতে পা দিয়ে বাংলার স্নেহস্নিগ্ধ কোমলতা তার চেতনায় মায়া ছড়িয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজের একটা মেয়ে থাকলে খুশি হত সে।
আর একটি বন্ধু জুটেছে, তার নাম বনশিধর। আড়তদার মহাবীর প্রসাদের ছেলে। কুড়ি বাইশ বছর বয়স, এর মধ্যেই সবরকম নেশায় সিদ্ধহস্ত। আলুকে সে তার দোসর করে নিয়েছে।
ফলে এই হয়েছে যে, জগদীশের দোকানে আলুকে আর গাঁটের কড়ি খরচ করতে হয় না। বনশিধর নিয়মিত তার নেশার খরচ জোগায়। হাতে প্রকান্ড ভোজালি নিয়ে বনশিধরের দেহরক্ষীর মতো তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় আলু খলিফা। চরিত্রগুণে বনশিধরের শত্রুর অভাব নেই, কিন্তু তার সহচরের দিকে চোখ পড়তেই শত্রুপক্ষের যা-কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতা সব প্রশমিত হয়ে যায়। অত্যন্ত খুশি হয় বনশিধর। বলে, পঞ্চাশ টাকা মাইনে দেব তোমাকে খলিফা, তুমি আমার খাস বরকন্দাজ বনে যাও।
প্রকান্ড মুখে করকরে হাসি হাসে আলু খলিফা।
কোনো দিন গোলামি করিনি, আজও করব না। তুমি আমার দোস্ত আছ এই ভালো।
দিন কাটছিল, নিস্তাপ নিরুদ্ভেজ জীবন। আলুর মন থেকে মুছে আসছিল অতীতের যা কিছু স্মৃতি। কোথায় কত দূরে লখনউ শহর, কোথায় সেসব হিংস্র উন্মত্ত দিন! চোখ বুজে ভাবতে গেলে সত্যকেই এখন স্বপ্ন বলে বিভ্রম এসে যায়। এই ঝাঁপ-ফেলা ছোটো দোকান। সামনে বন্দর টিনের চাল, খড়ের চাল, ছোটো ছোটো ফড়িয়া আর পাইকার। সকলের ওপরে জেগে আছে মহাবীর প্রসাদের হলদে রঙের দু-তলা বাড়িটি। প্রতিদিনের চেনা নির্বিরোধ সমস্ত মানুষের মুখ, ধুলোর গন্ধ, বেনেতি মশলার গন্ধ, খাসির রক্ত আর বাসি মাংসের গন্ধ, জগদীশের দোকানে মদের গন্ধ। বাবলা গাছের তলা দিয়ে, কাঁকর আর কুশের তীক্ষ্ণাগ্রে আকীর্ণ দিকপ্রান্তের মধ্য দিয়ে তেমনি করে বয়ে যায় ক্ষীণস্রোতা নদী। নিশীথ রাত্রে তেমনি করে গাংশালিকের ডাক ট্টি-ট্টি-ট্টি-হট–ট্টি – ট্টি-ট্টি–