কিন্তু কথাটা আর শেষ হতে পারল না। শীত-মন্থর আড়ষ্ট অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে পৈশাচিকভাবে হেসে উঠল লোকটা, ঝিকিয়ে উঠল হাতের ভোজালিখানা। জগদীশ দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মূর্তির মতো, শুধু হাঁটুর অস্থিসংস্থানগুলো যেন বিশৃঙ্খল হয়ে গিয়ে পা-দুটো থরথর করে কাঁপতে লাগল।
সরকারি আইন? আইনভাঙা মানুষ আমরা বাবু, আইন দেখিয়ো না। দু-পয়সা বেশি নেবে নাও, কিন্তু লক্ষীছেলের মতো এক বোতল কড়া মাল বার করো দেখি। ভোর বেলায় হামলি আমার ভালো লাগে না।
দেখা গেল, ভোর বেলায় হামলি জগদীশও পছন্দ করে না। নিঃশব্দে আলমারি খুলে সিল করা ত্রিশের একটা বোতল বার করলে। কর্ক স্কুর প্যাঁচ পড়ল, হিস শব্দ করে তীব্র অ্যালকোহলের খানিকটা বিষবাষ্প ছড়িয়ে গেল হাওয়ায়। কালো কোর্তাপরা রাক্ষসের মতো চেহারার মানুষটা বোতলটাকে মুখের কাছে তুলে ধরল। ঢকঢকঢক, এক নিশ্বাসেই আগুনের মতো বিশ আউন্স পানীয় নিঃশেষিত। এক বার মুখবিকৃতি করলে না, শরীরের কোনোখানে দেখা গেল না এতটুকু প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ। তারপর দুটো টাকা ছুড়ে দিলে টেবিলের ওপর, ভোজালিখানাকে হাতে তুলে নিলে, ব্যঙ্গচ্ছলেই কি না কে জানে জগদীশকে একটা সেলাম দিলে এবং পায়ের নাগরা জুতোর মচ মচ শব্দ করে বেরিয়ে গেল বাইরে। তমসাচ্ছন্ন কুয়াশায় মিলিয়ে গেল ভৌতিক একটা ছায়ামূর্তি।
আট গন্ডা পয়সার চেঞ্জ পাওনা ছিল লোকটার, ফেলে গেছে অবজ্ঞাভরে। কিন্তু সেদিকে মন ছিল না জগদীশের। হাঁটুটা তখনও কাঁপছে, বুকের মধ্যে রেলগাড়ির ইঞ্জিনের মতো শব্দ হচ্ছে তখনও। স্তব্ধ স্তম্ভিত জগদীশ ভাবতে লাগল কে এই লোকটা? যে এক নিশ্বাসে বিশ আউন্স আগুন পান করতে পারে এবং একটুখানি পা যার টলে না, যার হাসি অমন ভয়ানক এবং যার ভোজালি অমন ধারালো।
কিন্তু কয়েক দিন পরেই তার পরিচয় কারও কাছে অজানা রইল না।
লখনউ শহরের এক্সটার্নড় গুণ্ডা। মোট পাঁচ বার জেল খেটেছে। দু-বার রাহাজানিতে, তিন বার দাঙ্গায়। অবশ্য বয়সে ভাটা পড়েছে এখন, দাঙ্গা-রাহাজানি আলুর আর ভালো লাগে না। ছোটো একটা মাংসের দোকান বসিয়ে নির্বিঘ্নে কয়েকটা শান্তিপূর্ণ দিন যাপন করবার বাসনাই তার ছিল। কিন্তু পুলিশের বুদ্ধি একটু ভোঁতা, সব জিনিসই বোঝে কিছু দেরিতে। অতএব সারাজীবন উন্মত্ততার মধ্যে কাটিয়ে যখন প্রৌঢ়ত্বে নখদন্তগুলোকে সে আচ্ছাদিত করবার চেষ্টায় আছে, সেই সময়েই তার ওপরে এক্সটার্নমেন্টের অর্ডার এল।
প্রথমে ভেবেছিল মানবে না আইনের শাসন, লুকিয়ে থাকবে এদিকে-ওদিকে। কিন্তু বৈচিত্র্যের লোভ, পৃথিবীকে ভালো করে দেখবার একটা মোহ তার মনকে আচ্ছন্ন করে দিলে। এই লখনউ শহর, নবাবি আমলের বাগ-বাগিচা, চকবাজার, এর বাইরে কোন পরিধি, কত বড়ো বিস্তীর্ণ জগৎ? লখনউয়ের লু-হাওয়া ঘূর্ণির ঝড় উড়িয়ে ডাক পাঠাল আলু খালিফাঁকে। ট্রেন ছুটে এল কলকাতায়।
ক্যানিং স্ট্রিটের এক খোলার ঘরে গ্রেট মোগলাই হোটেল। সেই হোটেলের ম্যানেজার একদিন খুন হয়ে গেল। ফুসফুসের মধ্যে ভোজালির ধারালো ফলা বিঁধে গেছে আদ্যন্ত। আলু খলিফার কিছু হাত ছিল কি না অথবা কতখানি হাত ছিল ভগবান বলতে পারেন। কিন্তু পুলিশ আবার পেছনে লাগল, আলুকে কলকাতা ছাড়তে হল।
তারপর ঘুরতে ঘুরতে সে এসে পড়েছে এই পান্ডববর্জিত দেশে। উত্তরবাংলার এক প্রান্তে মাঝারি গোছের একটা গঞ্জ। ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে ক্ষীণস্রোতা পাহাড়ি নদী বয়ে চলেছে সরীসৃপ-গতিতে। বাবলা গাছের ডালে বসে আছে শঙ্খচিল। এপারে ছোটো গঞ্জ-বাঙালি
আর হিন্দুস্থানি ধান ব্যবসায়ীর উপনিবেশ। ওপারে ঢালু ব্ৰহ্মডাঙা—শস্যহীন কুশ আর কাঁকরে আকীর্ণ। তারই ভেতর দিয়ে গোরুর গাড়ির ধূলিমলিন পথ চলে গেছে যোলো মাইল দূরের রেলস্টেশনে। ছোটো-বড়ো রাঙামাটির টিলার উপরে বিচ্ছিন্ন তাল গাছগুলো নিঃসঙ্গতার বিরাট ব্যঞ্জনা।
আলু খলিফার ভালো লাগল জায়গাটা। আকাশে-বাতাসে, ভাষায়-মানুষে আর সীমাহীন শূন্যতার কোথায় যেন তার দেশের সঙ্গে মিল আছে এর। তা ছাড়া ফেরারির পক্ষে এর চাইতে নিরাপদ জায়গা আর কী কল্পনা করা চলে। সংসারে অবলম্বন তার দুটি ছেলে, দুজনেই গেছে যুদ্ধ করতে, কোনো দিন ফিরবে কি না কেউ জানে না। সুতরাং স্বচ্ছন্দ মনে জীবনের বাকি দিন ক-টা এখানে বানপ্রস্থ যাপন করতে পারে আলু খলিফা।
দিন কয়েকের মধ্যেই বন্দরের এক পাশে গড়ে উঠল ছোটো একটা মাংসের দোকান। যে ভোজালি সে রাগের মাথায় গ্রেট মোগলাই হোটেলের ম্যানেজারের বুকে বসিয়ে দিয়েছিল এবং অন্তত সাতটি মানুষের রক্তকণিকা যার বাঁটে অনুসন্ধান করলে খুঁজে পাওয়া যায়, সেই ভোজালি দিয়ে কচাকচ খাসির গলা কাটতে শুরু করে দিলে। মানুষ আর খাসির মধ্যে তফাত নেই কিছু, কাটবার সময়ে একইরকম মনে হয়। তা ছাড়া প্রথম মানুষ মারবার যে উত্তেজনা, লখনউ শহরে দু-তিনটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরে সে-উত্তেজনা ভোঁতা হয়ে গেছে। মানুষ কাটলে ফাঁসির ভয় আছে, কিন্তু পশুর বেলায় তা নেই। অতএব অর্থকরী এবং নিরাপদ দিকটাই বেছে নেওয়া ভালো।
বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে নতুন জীবন। দৈনিক একটা খাসি, কখনো-বা একটা বকরি জবাই দেয় আলু। রুদ্ধকণ্ঠ পশুটার শ্বাসনালি বিদীর্ণ করে দেয় তীক্ষ্ণধার ভোজালি। তিরের মতো ধারায় ছুটে যায় রক্ত, মুমূর্ষ অহিংস জীবন মাটিতে লুটিয়ে ছটফট করে। অদূরে দাঁড়িয়ে পরিতৃপ্ত চোখে আলু লক্ষ করে তার মৃত্যুযন্ত্রণা। রক্ত আর ধুলোর মিলিত কটুগন্ধ ছড়িয়ে যায় আকাশে। খচ খচ করে চলতে থাকে অস্ত্র। তারপর দড়ি-ঝোলানো ছোটো-বড়ো মাংসখন্ড ক্রেতাদের লোভ বর্ধন করে।