বললুম, যাঁ– কিছু লাভ হল বই কি।
লোকটা বললে, তবেই দেখুন কাজটা নেহাত মন্দ নয়। উঃ- নাকটা বেজায় জ্বলছে। একটা বিড়ি খাই–কী বলেন?
বললুম, তা খাও। তবে এবার আর মুখ পুড়িয়ো না।
না স্যার, বার বার কি ভুল হয়।– বলে পাশের পকেট থেকে একটা মানিব্যাগ বের করে সে হাতের উপর উপুড় করলে। বিড়ি বেরুল না– ছোট-ছোট আলুভাজার মতো পাঁচটা নয়া পয়সা পড়ল।
— কী মুস্কিল-বিড়িগুলো গেল কোথায়?
লোকটার বোকামি দেখে আমার গা জ্বলে উঠল। বললুম, ওটা মানিব্যাগ। ওর মধ্যে বিড়ি কী করে আসবে?
–তা বটে–এটা মানিব্যাগ লোকটা সেটাকে টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল; সেই রুমাল নিয়ে কেলেঙ্কারি হওয়ার পর একটা ব্যাগ কিনেছি। বুক-পকেটে রাখি। যতই মনের ভুল হোক স্যার নিজের বুক পকেট কেউ মারতে পারে না। পারে স্যার?
একমাত্র তুমিই পারো বোধ হয়।
না স্যার, তিন মাসের মধ্যে আমিও পারিনি। কিন্তু বিড়ি একটা না-খেলেই নয়। বলে, আবার বিড়ি খুঁজতে যাচ্ছে, হঠাৎ ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে টং টং করে তিনটে বাজল।
–অ্যা–তিনটে? কী সর্বনাশ।–
-সর্বনাশ কেন?
বাড়িতে বলে এসেছি যে। তিনটের মধ্যে না ফিরলে তারা ভাববে আমাকে পুলিশ ধরেছে। আপনি একটু উঠুন না স্যার।
-কেন?
–আমাকে থানায় দিয়ে আসবেন।
এবার আমার ভারি রাগ হল। রাত দুপুরে এ কী জ্বালাতন! একটু ঘুমুতে পেলুম না– এখন আবার থানায় দৌড়োই বললুম, তুমি বাড়ি যাও– আমার আর হাড় জ্বালিয়ো না।
লোকটা মিনতি করে বললে, একবারটি চলুন না স্যার, ধরিয়ে দিয়ে আসবেন। আমি বাড়িতে বলে এসেছি–।
ধৈর্য আর কতক্ষণ থাকে। আমি হঠাৎ বেদম চিৎকার করে উঠলুম : গেট আউট-বেরোও–বেরোও বলছি
সেই চিৎকারে বিষয় চমকে লোকটা জানালা বেয়ে টপ করে লাফিয়ে পড়ল। কেঁউ করে একটা কাতর আর্তনাদ উঠল বুঝলুম, নেড়ী কুকুরের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছে। ভুল করে আবার জ্বালাতে না আসে, এই ভেবে শক্ত করে জানালাটা এঁটে দিলুম।
সকালে দেখি, টেবিলের ওপর পাঁচটা আলুভাজার মতো নয়া পয়সা আর মানিব্যাগটা পড়ে আছে। আমার চশমার খাপটা পাওয়া গেল না যাওয়ার সময় মানিব্যাগ ভেবে সেইটে নিয়েই পালিয়েছে।
আলু খলিফার শেষ খুন
আগে নাম ছিল আলাউদ্দিন, সংক্ষেপে দাঁড়াল আলু। আলু নয়, আলু খলিফা।
লখনউয়ের মুসলমান—জাত কশাইয়ের ছেলে। লাল টকটকে দুটো চোখ যেন হিংসায় আরক্তিম হয়ে আছে। হাতে লম্বা একখানা চকচকে ভোজালি; তার হাতির দাঁতের বাঁটটার রং প্রথমে ছিল দুধের মতো সাদা, কিন্তু অনেক পশুর রক্ত জমতে জমতে তার রং হয়েছে। কুচকুচে কালো। শুধু ভোজালির ফলাটায় এতটুকু মালিন্য পড়েনি, ক্রমাগত রক্ত-মাংসের শান পড়ে পড়ে যেন তার ওপর থেকে হিরের আলো ঝলকে যায়।
আকস্মিক একদিন দর্শন দিলে প্রেতমূর্তির মতো।
শীতের সকাল, কিন্তু সকাল হয়নি। শেষরাত থেকে নেমেছে স্তরে স্তরে কুয়াশা। দূরের নিদ্রিত নির্বাক সিংহাবাদের বিস্তীর্ণ হিজলের বন থেকে, কৃষ্ণকালীর বিলের দুর্গন্ধ-ভরা জলের ওপর থেকে সেই কুয়াশা উঠে এসেছে। সমস্ত বন্দরটা শীতের আড়ষ্টতায় পড়ে আছে মূৰ্ছাতুরের মতো। দু-হাত দূরের মানুষ চোখে দেখা যায় না।
মদ-গাঁজার সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ভেণ্ডার জগদীশ তখন অঘোরে ঘুমে মগ্ন। জগদীশ নেশা করে না, কিন্তু দিনরাত নেশার জিনিস নাড়াচাড়া করে তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে এক-জাতীয় অভ্যস্ততা এসে দেখা দিয়েছে। নিজের পরিচিত জায়গাটিতে না শুলে ঘুম আসে না জগদীশের। কেরোসিন-কাঠের পুরোনো তক্তাপোশ থেকে সরাসরি ছারপোকা সারারাত সুড়সুড়ি দেয়। মাথার কাছে পায়া-ভাঙা টেবিলে গাঁজার নিক্তি আর গাঁজার পুরিয়া থেকে নিরুদ্ধ ঘরের মধ্যে অত্যুগ্র দুর্গন্ধ ভেসে ভেসে বেড়ায়। পায়ের কাছে পঁয়তাল্লিশ গ্যালন মদের পিপা থেকে পচা মহুয়া, চিটেগুড় আর অ্যালকোহলের একটা সুরভি নিশ্বাসে নিশ্বাসে জগদীশের স্নায়ুগুলোকে রোমাঞ্চিত করে তোলে। ওয়াড়হীন বাঁদিপোতার লেপে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে জগদীশ মধুর স্বপ্নে তলিয়ে থাকে। স্বপ্ন দেখে বন্দরের খোকা ভুঁইমালীর সুন্দরী বিধবা বোনটা তার জন্যে এক খিলি দোক্তা-দেওয়া পান এনে সোহাগভরা গলায় তাকে সাধাসাধি করছে।
আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে জগদীশ লেপের মধ্যে যখন বিড়বিড় করে উঠেছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই কানের কাছে যেন বাজ ডেকে গেল।
খোকা ভুঁইমালীর সুন্দরী বোনের কোকিলকণ্ঠ নয়, এমনকী খোকার কটকটে ব্যাঙের মতো গলাও নয়। জগদীশ লাফিয়ে উঠে বসল।
বন্ধ দরজায় তখন লাঠির ঘা পড়ছে। ঘরের মধ্যে শীতার্ত অন্ধকারে মিটমিট করছে লণ্ঠনের লালশিখা, রাত শেষ হয়েছে কি না জগদীশ অনুমান করতে পারল না। এমন অসময়ে যেভাবে হাঁকাহাঁকি করছে, ডাকাত পড়ল না কি?
শীতে আর ভয়ে জগদীশের দাঁত ঠক ঠক করে বেজে উঠল, কে?
দারু চাই বাবু।
দারু। জগদীশের ধড়ে প্রাণ এল। নিশ্চয় মাতাল। অসীম বিরক্তিভাবে দাঁত খিচিয়ে বিশ্রী একটা শব্দ করলে জগদীশ, এই মাঝরাত্তিরে দারু? ইয়ার্কি পেলি নাকি? যা ব্যাটা, পালা।
আরও জোরগলায় কথাটার পুনরাবৃত্তি শোনা গেল, দারু চাই বাবু।
ক্রুদ্ধ জগদীশ লেপটাকে গায়ে জড়িয়ে নিয়েই উঠে পড়ল, ধড়াস করে খুলে ফেললে দরজাটা। যাচ্ছেতাই একটা গাল দিয়ে বললে, সরকারি আইন জানিস? বেলা ন-টার আগে…