ভজনলাল নাকি? দারুণ চমকে উঠে দেখলেন, ভজনলাল নয়। রোগা লম্বা চেহারার এক ভদ্রলোক, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, হাতে ছড়ি।
ভদ্রলোক আবার বললেন, এই যে, আপনিই বোধ হয় রামগতিবাবু?
সন্দিগ্ধ হয়ে রামগতি থেমে দাঁড়ালেন।
–হ্যাঁ। কী বলতে চান বলুন।
–আমি এখানকার স্কুলের হেডমাস্টার। জুলজিতে এমএসসি। আপনাকে একটা কথা জানাতে চাই। আপনারা ছাইপাঁশ নভেল লেখেন– কিন্তু লেখাপড়ার ধার দিয়েও যান না কোনওদিন। আপনাকে কে বলেছে তুরপুন বিঁধিয়ে হাঙর শিকার করা যায়?
রামগতিবাবুর মাথার ভেতর ধাঁ করে জ্বলে উঠল। আবার সেই ভজা। ভজাই তাঁকে পাগল করে দেবে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে রামগতিবাবু বললেন, আমি কখনও এসব কথা বলিনি।
–আলবাত বলেছেন! শহরসুদ্ধ লোককে বলে বেড়িয়েছেন। এই সব যা-তা লিখেই ছেলেপুলের মাথা খান–তারা গোল্লায় যায়। হেডমাস্টার বেতের লাঠিটা ঠুকলেন রাস্তার ওপর : হাঙর সম্বন্ধে কোনও আইডিয়া আছে আপনার? কোনওদিন দেখেছেন হাঙর?
–আগে দেখিনি। এখানে এসে দেখছি। চারদিকেই দেখতে পাচ্ছি তাদের। আপনারা সবাই হচ্ছেন এক-একটা নাদাপেটা ভেটকিমুখো হাঙর। রামগতিবাবু জবাব দিলেন।
হেডমাস্টার বললেন, ইমপসিবল। মানুষ কখনও হাঙর হয় না। হাঙরের নাদাপেট হতেই পারে না। হাঙর ভেটকিমুখো হয় না–হয় গ্রপার! গ্ৰপারকে অবশ্য নাদা পেটা ভেটকিমুখো বলা যেতে পারে। আপনি মাছ সম্বন্ধে কিছুই জানেন না।
জানি না তো বয়েই গেল বলে হনহন করে রামগতিবাবু এগিয়ে গেলেন। পেছন থেকে হেডমাস্টার চিৎকার করে বললেন, আপনি আমার ছাত্র হলে টেস্টে কিছুতেই অ্যালাউ করতুম না।
কোনওদিকে না তাকিয়ে রামগতিবাবু এবার সোজা নদীর ধারে চলে এলেন। খাসা জায়গাটি। পাথরের ওপর দিয়ে ফেনা তুলে নীল জল নেচে চলেছে। দিব্যি হাওয়া দিচ্ছে ঝিরঝির করছে পাহাড়ি ঝাউয়ের পাতা। কিন্তু মনে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না। এমন মনোমত জায়গা– বসে বসে নিশ্চিন্তে দু’খানা উপন্যাস আর দশ ডজন কবিতা লেখা যেত কিন্তু ভজার জ্বালাতেই তাঁকে এখান থেকে পালাতে হবে মনে হচ্ছে। যা নয় তা রটিয়ে বেড়াচ্ছে– লোকে বোধ হয় পাগল বলছে তাঁকে। এরকম মারাত্মক ভক্তও লোকের জোটে–ওঃ!
.
তবু নদীর ধারে বসে থেকে মনটা শান্ত হল। তারপর এদিক-ওদিক ঘুরে বস্তি থেকে শস্তায় একজোড়া মুরগি কিনে যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন বলতে কী, বেশ ভালোই লাগছিল রামগতিবাবুর।
কিন্তু ভালো লাগাটা বেশিক্ষণ রইল না। এক পেয়ালা চা খেয়ে কালকের কবিতাটা নিয়ে কেবল বসেছেন, আর লিখেছেন :
সেই সব ডিম যা স্বপ্ন দেখছিল বালির তলায়
ভাবছিল কবে ঘোড়া হয়ে উড়ে যাবে দিগন্ত সীমায়
ঠিক তক্ষুনি কে ডাকল : রামগতিবাবু।
নিশ্চয় ভজু! খাতা রেখে তেড়ে বেরিয়ে গেলেন রামগতিবাবু, কিন্তু এবারেও–এবারেও ভজনলাল নয়।
–আমি থানা থেকে আসছি।
বলবার দরকার ছিল না, চেহারা দেখেই সেটা মালুম হচ্ছিল রামগতির।
–আমার-আমার কাছে কী দরকার?
–আপনি আজ সকালে সাংচু নদীর ধারে গিয়েছিলেন?
রামগতি ঢোক গিললেন।
–তা গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে যাওয়াতে যে কোনও দোষ
–থামুন। সেখানে আপনি কুরপুন না তুরপুন দিয়ে মাছ মেরেছেন কেন?
থানার লোকটির স্বর এবার গুরুগম্ভীর।
-মাছ মেরেছি? রামগতি আকাশ থেকে পড়লেন।
-হ্যাঁ, মেরেছেন। কী বলে– কী বলে কী একটা কারপুন না চারপুন দিয়ে আপনি সব জায়গায় মাছ মেরে বেড়ান- এ কথা সবাই জানে। কেন মেরেছেন মাছ? জানেন, ওটা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের আন্ডারে? জানেন, বিনা পারমিশনে ওখানে মাছ মারলে ফাইন হয়?
রামগতিবাবু হাহাকার করে উঠলেন : কখনও না–আমি মাছ মারিনি। বস্তি থেকে দুটো মুরগি কিনেছি কেবল। বিশ্বাস না হয়–
লোকটি বললেন– হুম! বিশ্বাসটা কাল কোর্টে গিয়ে করাবেন। বেলা ঠিক সাড়ে দশটায়। এই নিন সমন। মাছ না মুরগি কালকেই বোঝা যাবে সেটা।
সমন তো সমন! সেইটে হাতে করে দাঁড়িয়ে রইলেন রামগতিবাবু। একেবারে নিটোল একটি উটপাখির ডিমের মতোই।
পঁচিশ টাকা ফাইন হয়ে গেল।
আর ফাইন দিয়েই বাসায় ফিরলেন রামগতিবাবু। তক্ষুনি কুলি ডাকলেন, বিছানা বাঁধলেন, তারপর গিন্নির গালাগাল শুনতে শুনতে সোজা স্টেশনে। এখানে আর একদিনও তিনি থাকবেন না–এক মুহূর্তও নয়! দুদিনেই এই! চারদিন পরে তো তা হলে ফাঁসি যেতে হবে।
ট্রেন ছাড়ে ছাড়ে, ঠিক সেই সময় কোত্থেকে ভজু এসে হাজির। সেই ভজনলাল পতিতুণ্ডি। সেই শাল কাঁধে, সেই নাকের নীচে সরু গোঁফের রেখা, সেই গোঁফের তলায় বিগলিত হাসি।
এ কী স্যার চলে যাচ্ছেন? এত তাড়াতাড়ি?–ভজনলালের গলায় মর্মান্তিক ব্যথা : দুদিন আপনাকে কাছে পেতে-না-পেতেই হারালুম!
রামগতিবাবুর গিন্নি ঘোমটার আড়াল থেকে গজরাচ্ছিলেন : আ মর মুখপোড়া লক্ষ্মীছাড়া কোথাকার! কিন্তু রামগতি গজরালেন না, হুঙ্কার ছাড়লেন না কিছুই বললেন না। কেবল দার্শনিকের মতো বললেন, কপাল!
ট্রেনের বাঁশি বাজল!
ভজু ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এল।
-স্যার, আপনার কলকাতার ঠিকানাটা? কলকাতায় গেলে দেখা করব।
আরও শান্ত হয়ে গেলেন রামগতিবাবু : জানলা দিয়ে মাথাটা বাড়িয়ে দাও–বলছি।
ট্রেন চলতে শুরু করেছে।
জানালায় মাথা গলিয়ে ভজু সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছে : ঠিকানা ঠিকানা?
–এই যে।