–আর জেনে যাও–তারপুন নয়, হারপুন।
–হ্যাঁ–তারপুন নয় হারপুন, হারপুন-ভজনলাল অদৃশ্য হল।
–বিকেলটাই বরবাদ করে দিয়ে গেল হতচ্ছাড়া। রামগতিবাবু স্বগতোক্তি করলেন : চা আর ওমলেটের পয়সাটা আদায় করে নিতে পারলে ঠিক হত। ভক্ত না ঘোড়ার ডিম :হুঁঃ।
.
রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি। গিন্নি স্টোভে মাংস রান্না করছেন, পাশের ঘর থেকে তার মনোরম গন্ধ আসছে। সেই গন্ধে রামগতিবাবুর ভাব এসে গেল। চাদর দিয়ে বেশ করে কানটান ঢেকে নিয়ে তিনি কবিতা লিখতে বসলেন :
ঝম ঝম করছে রাত আর ঝিমঝিম করছে তারা,
বাইরে নেড়ী কুকুর শেয়ালকে লাগাচ্ছে তাড়া।
এই রাতে সাহারা মরুভূমিতে নেমেছে ধূসর হিম,
আর তিনজন বেদুইন হুঁকো টানতে টানতে খুঁজছে
কয়েকটি উটপাখির ডিম
বেশ জমাট করে এই পর্যন্ত লিখেছেন, হঠাৎ ভাবটা কড়াৎ করে ঘুড়ির মতো কেটে গেল। বাইরে কে যেন খটাং করে কড়া নাড়ল।
আঃ, এই রাতে– এমন শীতের ভেতর কে জ্বালাতে এল? সেই ভজনলালটা নয় তো? রামগতিবাবু ভুরু কোঁচকালেন।
আবার খট-খট-খটাং
বিকটরকম দাঁত খিঁচিয়ে রামগতিবাবু দরজা খুলে দিলেন। ভজু এলে এবারে তাকে ঘাড়ধাক্কা দেবেন নির্ঘাত।
কিন্তু ভজু নয়। মাথায় চকচকে টাক, কান-পর্যন্ত-তুলে-দেওয়া মোটা পাকা মিলিটারি গোঁফ, গায়ে ওভারকোট, হাতে চুরুট, বদমেজাজী চেহারার এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে।
ভদ্রলোক ভরাট গম্ভীর গলায় বললেন, ইভনিং। একটু বেশি রাতে ডিসটার্ব করলুম বলে কিছু মনে করবেন না।- রামগতিবাবুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বললেন, আপনারই নাম রামগতি সমাজপতি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো
–আমি জে. কে. ঘোষ, কর্নেল ঘোষ বলে লোকে আমাকে জানে। মিলিটারিতে ছিলুম থার্টি ইয়ার্স। এখন রিটায়ার্ড।
-ওঃ, আসুন আসুন। নমস্কার। ভেতরে আসুন।
ঘরে ঢুকে ভদ্রলোক ধপাৎ করে একখানা চেয়ারে দেহরক্ষা করলেন। চেয়ারটা মটমটিয়ে উঠল। মোটা চুরুটটা থেকে একরাশ বিচ্ছিরি ধোঁয়া রামগতিবাবুর মুখের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে কর্নেল ঘোষ গাঁ-গাঁ করে বললেন, ক্লাবে শুনে এলুম আপনি নাকি খুব বড় শিকারি। হাতি-গণ্ডার-সিংহ এইসব শিকার করে থাকেন। আমিও আফ্রিকায় ছিলুম, কেনিয়ায় কঙ্গোতে। শিকারি হিসেবে জে. কে. ঘোষের কিছু নামও ছিল। তাই ভাবলুম যিনি রাশি রাশি হাতি-গণ্ডার শিকার করে থাকেন, সেই বীরপুরুষকে একবার দেখে আসা দরকার।
রামগতিবাবু হাঁ করে রইলেন কিছুক্ষণ।
-কিন্তু আমি তো হাতি-গণ্ডার
কর্নেল ঘোষ মিলিটারি গোঁফে তা দিয়ে বললেন, শিকার করেননি– করতে পারেন না। এই গোলগাল নন্দদুলাল চেহারা ভূঁড়ি-ভর্তি চর্বি আপনি করবেন শিকার। ছোঁ। শিকারির চেহারা কখনও এইরকম হয় না।
রামগতিবাবু বিব্রত হয়ে বললেন, কী জ্বালা! আপনাকে কে বলেছে আমি শিকার
-শাট আপ! কর্নেল ঘোষ চোখ পাকিয়ে বললেন, চালিয়াতির আর জায়গা পাননি। আমি কর্নেল জে. কে. ঘোষ–আমার সঙ্গে চালাকি করতে এসেছেন! জীবনে কোনওদিন রাইফেল ধরেছেন আপনি? ধরতে জানেন? আই ডোন্ট বিলিভ ইট! দেখি আপনার হাত
রামগতিবাবু হাঁ-হাঁ করে উঠতে গিয়ে হাহাকার করে উঠলেন। ততক্ষণ কর্নেল ঘোষ তাঁর ডান হাত পাঞ্জায় ধরে একটি চাপ দিয়েছেন আর হাতের আঙুলগুলো এক সঙ্গে মটমট করে উঠেছে।
–ছাড়ুন–ছাড়ুন–মরে গেলুম–উহুহু ই-হি-হি
–হুঁ, মারাই যাবেন এরপর। শিকারির আঙুল। ছোঃ–একতাল কাদা। আপনাদের মতো বাজে লোকদের জন্যে খাঁটি শিকারিদের বদনাম। ফের যদি এসব গুলবাজি করেন তা হলে এরপর এসে দুটো হাতই ভেঙে দিয়ে যাব। রাবিশ।
কর্নেল ঘোষ উঠে দাঁড়ালেন। ধাক্কা দিয়ে চেয়ারটা ফেলে দিয়ে ধড়াস করে দরজাটা আছড়ে বেরিয়ে গেলেন।
ততক্ষণে মাংস রান্না ফেলে গিন্নি ছুটে এসেছেন।
কী হল গো? এত গণ্ডগোল কিসের।
–একটা খুনে লোক এসে বোধহয় আঙুলগুলো ভেঙেই দিয়ে গেল গিন্নি উহুহু
গিন্নি চেঁচিয়ে উঠলেন; ওমা গো–কী হবে গো! থানা-পুলিশ-খুন
–দুত্তোর থানা-পুলিশ। রামগতিবাবু বিকট মুখ ভ্যাংচালেন : থানা-পুলিশ কী করবে মিলিটারির কাছে। ই-হি-হি-এই শীতের ব্যথা! তুমি শিগগির এক প্যান গরম জল করে আনো–শিগগির
.
সকালে উঠে গোঁজ হয়ে রামগতিবাবু ভাবতে লাগলেন, এ সব ভজার জন্যে। সে-ই যা-তা রটিয়েছে তাঁর নামে। রাত দুটো পর্যন্ত সেঁক দিয়ে এখন আঙুলের ব্যাথাটা কমেছে বটে, কিন্তু মনের ভেতরে আগুন জ্বলছে সমানে। ভজাকে একবার সামনে পেলে–
কিন্তু সামনে যখন পাওয়া যাচ্ছে না– তখন মন খারাপ করে বসে থেকে আর কী হবে। আর সেই কালান্তক কর্নেল ঘোষকে সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে কোথাও পেতে চান না তিনি। পাওয়ার কোনও দরকার বোধ করছেন না রামগতিবাবু।
দূরে সকালের পাহাড়ি নদীটা ঝিলমিল করছিল। আরও খানিকক্ষণ ব্যাজার হয়ে বসে থেকে ভাবলেন নদীর ধার থেকে একটু বেড়িয়ে আসবেন। কালকে সেই উটের ডিম নিয়ে কবিতাটা বেশ জমাট হয়ে উঠেছিল, সেটার বারোটা বেজে গেছে। ভাবলেন, নদীর ধার থেকে একটু মুড নিয়ে আসবেন।
নিরিবিলি পাহাড়ি পথের ধার বেয়ে চলেছেন। দুধারে শাদা শাদা পাহাড়ি ফুলে গাছগুলো ছেয়ে আছে, পাখি-টাখি ডাকছে– রামগতিবাবুর গলায় খুসখুস করতে লাগল। সবে গুনগুন করে গানের একটা কলি ধরেছেন এমন সময় কে যেন বললে, এই যে।