ছেলেটি এসেই তাঁর পায়ের ধুলো নিলে, তারপর হাতটা একবার জিভে ঠেকাল। গদগদ হয়ে বললে, কতদিন দূরের থেকে দেখেছি, আজ পদধূলি পেয়ে জীবন ধন্য হল।
–আপনি আমাকে চেনেন নাকি?
–বিলক্ষণ! ছেলেটি চোখ কপালে তুলল; দিকপাল লেখক রামগতি সমাজপতিকে বাংলাদেশে কে না চেনে। কাল যখন ট্রেন থেকে আপনি নামলেন, তখনই দেখেছি। কোথায় উঠেছেন খোঁজ নিয়ে আজ দেখা করতে এলাম। আমি স্যার, আপনার লেখার দারুণ ভক্ত। আপনার উপন্যাস পড়ে আমার মনে হয় আপনি বঙ্কিমের চাইতেও বড় লেখক, আপনার অনেক কবিতা স্যার, রবি ঠাকুরের চেয়েও ভালো।
রামগতিবাবু দারুণ খুশি হলেন– পত্রিকার সম্পাদক আর প্রকাশকেরা কথাটা শুনলে কাজ হত। একটু লজ্জাও পেলেন সেই সঙ্গে। বললেন, না না, অতটা বাড়িয়ে বলবেন না, আমি একজন সামান্য লেখক–
সামান্য! কী বলেন আপনি! আমার তো মনে হয় আপনাকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া উচিত।
রামগতিবাবুর দীর্ঘশ্বাস পড়ল। হতচ্ছাড়া বাংলাদেশের লোক কি তা বোঝে! কখনও কখনও দু-একটা সমালোচক তাঁর বইয়ের এমন নিন্দে-মন্দ করে যে, মনের দুঃখে লেখা-টেখা ছেড়ে দিয়ে তাঁর সন্ন্যাসী হতে ইচ্ছে করে। রামগতিবাবু বললেন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন-বসুন। চা খাবেন একটু?
–আপনার এখানে চা খাব? এ তো স্যার, আমার স্বপ্নের অতীত। তবে দয়া করে আমাকে আর আপনি বলবেন না। আমার নাম ভজনলাল পতিতুণ্ডি– আপনি আমায় ভজু বলেই ডাকবেন।
রামগতিবাবু ভজুর জন্যে চা আনলেন। কিন্তু এমন ভক্তকে কি শুধু চা খাওয়ালেই চলে? চারখানা বিস্কুট আর ডবল ডিমের একটা ওমলেটও খাওয়াতে হল। দেখা গেল, ভজনলাল ভোজন আর ভক্তি কোনওটাতেই পেছপা নয়। বেশ চেটেপুটেই খেল। আর একটা ডবল ডিমের ওমলেট পেলেও তার আপত্তি হত না বলেই রামগতিবাবুর মনে হল। কিন্তু ভরসা করে গিন্নিকে সেকথা তিনি বলতে পারলেন না-হয়তো বা খ্যাঁক খ্যাঁক করে চেঁচিয়েই উঠবেন ভদ্রমহিলা।
খেয়ে-দেয়ে খুশি হয়ে ভজু হাত কচলাতে লাগল।
–আচ্ছা স্যার
–বলো!
আহ্লাদে গলায় ভজু বললেন, এত সব আইডিয়া আপনার মাথায় কী করে আসে? ওই যে আপনার ‘কে তুমি পথিক’ উপন্যাসের এক জায়গায় লিখেছেন– এমন সময় হুলো বেড়ালটার আর্তনাদ যেন নীরব তিমিরের বুকে হারকুন বিদ্ধ করল– কী অদ্ভুত সে-জায়গাটা! পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আচ্ছা, হারকুন মানে কী? তারপুন বোধ হয়?
রামগতিবাবু বললেন, না–না, তারপুন নয়! হারকুনও নয়। লিখেছি হারপুন। মানে একরকম বল্লম–তাই দিয়ে তিমিমাছ শিকার করে।
–তিমিমাছ–অ্যাাঁ? কী কাণ্ড!–ভজুর চোখ দুটো একসঙ্গে যেন নাকের ওপর লাফিয়ে ওঠে তারপরে তার দু’কানের দিকে দৌড়ে গেল; বুঝেছি এইবারে। তিমির থেকে একেবারে তিমি-মারা তারপুন। কী আশ্চর্য– একেই বলে কল্পনা! তারপুন! ওফ!
-ওটা তারপুন নয়, হারপুন।–রামগতিবাবু সংশোধনের প্রয়াসী হলেন।
–হ্যাঁ-হ্যাঁ, হারপুন। আমি তো স্যার রাত্রে হুলো বেড়ালের ডাক শুনলে লাঠি নিয়ে তাড়া করি। আর আপনি কিনা একেবারে–ও! মানে, একেবারে হারতুন দিয়ে তিমিমাছ শিকার করে বসলেন।
হারতুন নয়–হারপুন।
–ঠিক ঠিক–হারপুন। আমি তো স্যার, কখনও তিমিমাছ শিকার করিনি আপনার মতো। জানব কী করে? উঃ–আপনি কিন্তু অসাধারণ লোক! তাই তো বলি, খালি খালি ঘরে বসে থাকলেই কি লেখক হওয়া যায়! ডালমুট চিবিয়ে আর চা খেয়ে কি কেউ অত ভালো-ভালো জিনিস লিখতে পারে। কারপুন দিয়ে তিমিমাছ শিকার করতে পারলে তবেই না–
কারপুন নয়, হারপুন।–এবার রামগতি একটু বিরক্ত হলেন।
-ঠিক ঠিক। সত্যি বলতে কি স্যার, আপনাকে দেখে আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে। আপনি বড় লেখক তা জানতুম, কিন্তু তিমিমাছও মারতে পারেন তা কে ভেবেছিল? আচ্ছা স্যার, রবি ঠাকুর এত বড় কবি হলেন কী করে? উনিও বোধ হয় গণ্ডার জলহস্তী এই সব শিকার করতেন– তাই নয়?
না, রবীন্দ্রনাথ কখনও গণ্ডার বা জলহস্তী শিকার করেননি। রামগতিবাবু গম্ভীর।
–তা হলে কি ঘোড়া শিকার করতেন? তাই বোধ হয় ‘ঘোড়া’ বলে একখানা কবিতার বই লিখেছিলেন। কিন্তু ঘোড়া কি কেউ শিকার করে?– ভজনলাল দারুণ ভাবে চিন্তা করতে লাগল; ঘোড়া শিকার করবার জিনিস নয়। বাঘ-সিঙ্গির মতো কাউকে তো কখনও কামড়েছে বলে শুনিনি। তাহলে খামকা ঘোড়া শিকার করে
রামগতিবাবু আরও বিরক্ত হলেন : আঃ, কী যে বকো–
–অ্যাঁ, কী বললেন? বক?–ঘোড়া নয়? রবীন্দ্রনাথ বক মারতেন?
-তোমার মাথায় কিছু নেই!–এতক্ষণে রামগতিবাবু ধৈর্য হারালেন, চা আর ওমলেট নেহাতই বাজে খরচ হয়েছে বলে মনে হল তাঁর : রবীন্দ্রনাথ বক মারতেন কে বলেছে তোমায়? তাঁর বইটার নাম ‘ঘোড়া’ নয়–গোরা। সেটা কবিতার বই নয়, উপন্যাস। আচ্ছা, তুমি এখন আসতে পারো।
-যাব স্যার? যেতে বলছেন?–এই সাহিত্যিক সদালাপ এমনভাবে বাধা পড়ায় ভজু ব্যথা পেল : আপনি আমায় যেতেই বলছেন তবে?
হুঁ, যেতেই বলছি তোমায়। দয়া করে আমায় রেহাই দাও এখন।
–ওঃ, লিখতে বসবেন বুঝি? তৈরি করবেন বাংলা সাহিত্যের আর-একখানা অ্যাটম বোমা? এ-বইতে তারকুন দিয়ে কী মারবেন স্যার? হাতি? ভজু তখনও কৌতূহলী।
–সিংহ-সিংহ মারব।–এবার সিংহের মতো গর্জন শোনা গেল রামগতিবাবুর।
ভজু তিন পা পেছিয়ে গেল। আর একবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে পায়ের ধুলো জিভে ঠেকাবার মতলব বোধহয় তার ছিল, কিন্তু সাহস পেল না। গুটি গুটি এগিয়ে গেল গেটের দিকে।